পোস্টকার্ড ব্লগের “ লোকায়ত কথোপকথন ” পাতাটি সবার জন্য উন্মুক্ত । লিখতে চাইলে আমাদের মেইল করে জানান । সাগ্রাহে আমরা আমান্ত্রন জানাবো। আমাদের মেইল ঠিকানা postcarduv@gmail.com। বাছাইকৃত লেখাটি পোস্ট কার্ড সংখ্যায় প্রকাশ করা হবে।

মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

চে: আদর্শ ও সংগ্রাম

“পৃথিবিতে যে কোন অন্যায় সংঘঠিত হলে তুমি যদি ক্রোধের আগুনে জ্বলে উঠো, তবে জানবে, আমরা কমরেড” - চে’ গুয়েভারা।


হ্যাঁ এই হচ্ছেন চে। পৃথিবীর নিরন্ন, অসহায় ও নির্যাতিত মানুষদের প্রতি শোষনের বিরুদ্ধে ক্রোধের আগুনে জ্বলে উঠতেন আর সেই ক্রোধকে ভালোবাসার মহৎ অনুভূতি দ্বারা পরিচালিত করে নিরন্তন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়াকে তিনি তার জীবনের তথা একজন বিপ্লবীর জীবনের প্রকৃত কাজ বলে মনে করতেন। আজ আমরাও অনেকে ক্রোধের আগুনে জ্বলে উঠি এবং এই জ্বলে উঠাই সার। ক্রোধের আগুন ফুঁস করে নিভে যেতে সময় লাগে না। ঘাটে একটু বুদ্ধি থাকলে সেই আগুনে কাবাব ঝলসে দুপয়সা কামাবার ফন্দি ফিকিরও করা যায়। আর তারই নমুনা হচ্ছে আলো ঝলমলে শপিংমলে চে’র টি শার্ট,কফি মগ আর চাবির রিং বিক্রির মহোৎসব। চে পরিনত হয় ছবি বা লোগোতে আর আদর্শ পরে থাকে হিমঘরে।


তবে এটাই শেষ কথা নয়। মৃত্যুর এতো বছর পরও আজো চে অনেক বেশী প্রাসঙ্গিক। এখনো পৃথিবীর নানা প্রান্তে অজস্ত্র নিপিড়ীত মানুষকে প্রতিবাদের শক্তি যোগায় চে। তাই আজকের এই বৈষম্যমূলক মুনাফা ভিত্তিক সমাজে সামগ্রিক পরিবর্তন ঘটিয়ে সম অধিকার ভিত্তিক মানবিক সমাজ গঠন করতে হলে চে’র জীবন ও আদর্শ পর্যালোচনা করা অনেক বেশী জরুরী।


দুনিয়াব্যাপী চে নামে পরিচিত হলেও চে’র প্রকৃত নাম আর্নেস্তো গুয়েভারা ডি লা সেরনা। চে নামটি তার কিউবান কমরেডদের দেয়া। এবং এই নামটিই চে বেশী পছন্দ করতেন। আর্নেস্তো জন্মগ্রহন করেন আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েন্স আয়ার্সের উত্তর পূর্বে রোসারিও নামক স্থানে। তার বাবা আর্নেস্তো গুয়েভারা লীনচ ও মা সেলিয়া ডি লা সেরনা। দুজনেই ছিলেন মুক্তমনা। তাদের বাড়িতে ছিল শিল্পী ও বুদ্ধিজীবীদের আনাগোনা। আর ছিল প্রচুর বই। ফলে চে ছোটবেলা থেকেই একটা সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে বড় হয়ে উঠেন। মাত্র বারো বছর বয়সে তিনি হাঁপানি রোগে আক্রান্ত হন এবং এই রোগ তাকে সারাজীবন ভুগিয়েছে। তবে খুব ছোট বেলাতেই এই রোগের সাথে যুঝতে গিয়ে তার মধ্যে প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তি আর মানসিক দৃঢ়তা বিকাশ লাভ করে। তার বাবা মা তাকে খেলাধুলা ও পড়াশোনাতে উৎসাহ দিতেন ফলে শৈশবেই তিনি সাঁতার, ঘোড়দৌড়, রাগবি, টেবিল টেনিস, স্যুটিং, গলফ ও দাবা খেলায় পারদর্শিতা অর্জন করেন। এই সময়ে চে বয়সের তুলনায় অনেক অগ্রসর বইপত্র পড়ে ফেলেন এবং সেই সাথে ফরাসি ভাষাটাও রপ্ত করে ফেলেন।


১৯৪৬ সালে আর্নেস্তো বুয়েন্স আয়ার্স বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসা শাস্ত্রে ভর্তি হন। প্রথম দিকে এলার্জি গবেষণায় তার আগ্রহ দেখা যায় এবং পরবর্তীতে তিনি একজন প্রখ্যাত গবেষক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। তিনি এমন কিছু করতে চাইতেন যা মানবতার সেবায় নির্ধারক ভূমিকা রাখবে। তবে এসবই ছিল তখন ব্যক্তিগত অর্জনের ব্যাপার। চে’র ভাষায় - “সকলের মত আমিও ছিলাম পরিবেশের উৎপাদ”।

ছাত্রবস্থায় নিজের খরচ চালানোর জন্য তাকে বিভিন্ন ধরনের কাজ করতে হয়। তিনি দক্ষিন আমেরিকায় ভ্রমনরত কার্গোশিপে নার্সের কাজ করেন। একটি এলার্জি ক্লিনিকে বেশ কবছর গবেষণা সহকারীর কাজও করেন। ১৯৫২ খৃষ্টাব্দে দক্ষিন আমেরিকায় ভ্রমনের সময় তিনি এবং তার বন্ধু আলবার্তো গ্রানাডো পেরুর কুষ্ঠ কলোনীতে কাজ করেন। স্নাতক পাশ করার পর আর্নেস্তো গুয়েতমালায় ভ্রমন করেন এবং সেখানে তিনি দুবছর গ্রাম্য ডাক্তার হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। এসময় তিনি লাতিন আমেরিকার বিপ্লবে ডাক্তাররা কি ধরনের ভূমিকা রাখতে পারে সে বিষয়ে একটি বই লিখেন। তিনি চিকিৎসাকে পেশা হিশেবে না নিলেও এই পেশার মাধ্যমেই জনগনের সাথে তার প্রথমিক যোগাযোগ গড়ে উঠে।


ডিসেম্বরের পরীক্ষার পর যখন অন্যান্য ছাত্ররা মার্চের পড়া ঝালিয়ে নিত তখন বইয়ের পাতায় বুদ হয়ে থাকার বদলে স্বপ্নে বিভোর চে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে বেড়িয়ে পড়তেন। অভিজ্ঞতা লাভের উদ্দেশ্যে ভ্রমন করতেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। ১৯৫০ সালে নিজের বাইসাইকেলে মোটর লাগিয়ে আর্নেস্তো বেরিয়ে পড়েন আর্জেন্টিনার ৩,০০০ মাইল ভ্রমনে। ১৯৫১ সালে তেইশ বছর বয়সী আর্নেস্তো ও তার বন্ধু উনত্রিশ বছর বয়সী আলবার্তো গ্রানাডো লাতিন আমেরিকা ভ্রমনে বের হন। প্রথমে তারা একটি নরটন ৫০০সিসি মোটর সাইকেল নিয়ে যাত্রা শুরু করেন, যার নাম তারা দিয়েছিলেন ‘লা পদারসা’। পরে এই মোটর সাইকেলটি ভেঙে পড়লেও স্বাপ্নিক তরুন দুজন ভেঙ্গে না পড়ে অন্যান্য যানবাহনের সাহায্যে তাদের ভ্রমন চালিয়ে যান। 



লাতিন আমেরিকার এই ভ্রমনের মাধ্যমে আর্নেস্তো শ্রমজীবী মানুষের দুঃখ কষ্ট স্বচক্ষে দেখতে পান।  এই সময় একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে। চিলিতে ওদের সাথে এক দরিদ্র শ্রমিক দম্পত্তির দেখা হয় যারা কমিউনিস্ট হওয়ার কারনে পুলিশের নিপীড়নের শিকার হয়েছিলেন। তাদের অবস্থা এতই করুন ছিল যে শীতের রাতে গায়ে দেয়ার জন্য একটিও কম্বল ছিল না। সেই রাতের ঘটনা আর্নেস্তোকে অসহায় মানুষগুলোর সাথে নৈকট্য অনুভবের সুযোগ করে দিয়েছিল। নিছক আনন্দের জন্য শুরু হয়েছিল যে ভ্রমন তা পরবর্তীতে শেষ হয় সমাজ পর্যবেক্ষনের এক গভীর অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যা তাকে ঐক্যবদ্ধ আমেরিকার সাধারন লক্ষ্যের প্রতি বিশ্বাসী করে তুলেছিল।



চিকিৎসা বিদ্যায় স্নাতক ডিগ্রি লাভের পর ১৯৫৩ সালের জুলাই মাসে আর্নেস্তো তার দ্বিতীয় লাতিন আমেরিকা ভ্রমন শুরু করেন। এবার তার সঙ্গী হলেন কার্লোস ‘কালিকা’ ফেরার। তারা বলিভিয়া ও পেরু হয়ে ইকুয়েডর পৌছেন। সেখান থেকে কালিকা কারাকাসে চলে যান আলবার্তো গ্রানাডোর সাথে দেখা করতে। আর আর্নেস্তো নৌকায় করে পানামায় পৌছান এবং সেখান থেকে কোস্টারিকা ও হন্ডুরাস হয়ে গুয়েতমালায় যান।

গুয়েতমালায় পৌছার পর আর্নেস্তোর সাথে ছ’জন কিউবান গেরিলার দেখা হয় যারা ১৯৫৩ এর ২৬ জুলাই ‘সান্টিয়াগো ডি মানকাদা’ ব্যারাকের ব্যর্থ আক্রমনে অংশ নিয়েছিলেন। আর্নেস্তো তখন এই অভিযানের নায়ক ফিদেল ক্যাস্ত্রোর কথা শুনে অভিভূত হন। ফিদেল তখন পাইনস দ্বীপে বাতিস্তার জেলে বন্দী ছিলেন। গুয়েতমালাতেই হিলদা গাদিয়ার সাথে আর্নেস্তোর পরিচয় হয়। হিলদা ছিলেন পেরুর রাজনৈতিক কর্মী। তিনি ছিলেন বয়সে চে’র থেকে তিন বছরের বড় এবং রাজনৈতিক ভাবে অনেক অভিজ্ঞ। পরবর্তীতে ১৯৫৫ সালে হিলদা ও চে বিয়ে করেন। হিলদাই চে’কে রুশ ধ্রুপদী সাহিত্য, জ্যাঁ পল সাত্রে ও চীনা বিপ্লবী মাও সে তুংয়ের লেখার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।


গুয়েতমালায় তখন তীব্র রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল। ১৯৫১ সালে প্রেসিডেন্ট জ্যাকোবো অরবেঞ্জ মার্কিন ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির জমি অধিগ্রহন করেন, তার ফলশ্রুতিতে ১৯৫৪ সালে হন্ডুরাস থেকে সিআইএ এর সমর্থন পুষ্ট হানাদার বাহিনী গুয়েতমালায় আক্রমন করে। আক্রমন প্রতিরোধ আন্দোলনে চে অংশগ্রহন করেন। কিন্তু সেই প্রতিরোধ ব্যর্থ হয়। অরবেঞ্জ পদত্যাগ করেন ও পালিয়ে মেক্সিকো দুতাবাসে আশ্রয় নেন। গুয়েতমালার এসব ঘটনাবলীর মধ্য দিয়ে চে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসনের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করেন এবং আগ্রাসন বিরোধী সংগ্রামে আরো দৃঢ় প্রতৃজ্ঞ হয়ে উঠেন। অরবেঞ্চ সরকারের পতনের পর আরো অনেকের সাথে হিলদা গাদিয়ার জেল হয়। কিন্তু হিলদা খুব দ্রুত জেল থেকে বেরিয়ে মেক্সিকোতে চলে যান। চে’ও সেসময় আলাদাভাবে মেক্সিকোতে পৌছান এবং ১৯৫৪ সালের অক্টোবরে হিলদার সাথে মিলিত হন।


১৯৫৫ সালে মেক্সিকোতে রাউল ক্যাস্ত্রোর সাথে চে’র পরিচয় হয়। ফিদেলের ভাই রাউল মনকাদা ব্যারাকের আক্রমনে অংশ নিয়েছিলেন। ৮ জুলাই ফিদেল ক্যাস্ত্রো কিউবার জেল থেকে মুক্ত হয়ে মেক্সিকো আসেন। দু’দিন পর ফিদেল ও চে’র দেখা হয় এবং প্রথম সাক্ষাতেই তারা প্রায় দশ ঘন্টার বৈঠকে মিলিত হন। এই সাক্ষাতের পর ফিদেল চে’কে তার গেরিলা বাহিনীতে গ্রহন করেন এবং চে তার ভাগ্যকে কিউবানদের সাথে পাকাপাকি ভাবে গেঁথে ফেলেন।


কিউবায় হামলার উদ্দেশ্যে ১৯৫৬ সালের মার্চে ফিদেল ক্যাস্ত্রো তার গেরিলাদের প্রশিক্ষন দেয়া শুরু করেন। তাদের প্রশিক্ষন ক্যাম্পটি ছিল মেক্সিকো সিটির বাইরে এক পশু খামারে। কিন্তু মেক্সিকোর পুলিশ খবর পেয়ে হামলা চালিয়ে প্রশিক্ষনরত গেরিলাদের বন্দি করে এবং ‘মিগুয়েল সুলজ’ বন্দিশিবিরে তাদের আটকে রাখে। পরে ফিদেল ক্যাস্ত্রো এক সপ্তাহ পর মুক্তি পেলেও চে’ ৫৭ দিন পর মুক্তি পান। সেসময় চে’ মেক্সিকোতে একজন অবৈধ বিদেশী হিসেবে ছিলেন এবং তাকে বিচারের জন্য বিদেশী সরকারের হাতে অর্পনের সম্ভাবনা ছিল। চে চাইছিলেন যাতে তার জন্য বিপ্লবের কোনো ক্ষতি না হয়। তাই তিনি ফিদেলকে বলেন সে তাকে ফেলে যেতে পারে এবং তাকে যেখানেই পাঠানো হোক না কেন তিনি সেখান থেকেই লড়াইয়ে যোগদানের চেষ্টা করবেন। কিন্তু চে’র প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে ফিদেলের দৃঢ় উত্তর ছিল “আমি তোমাকে ছেড়ে যাবো না”। এবং ফিদেল তাই করেছিলেন। মূল্যবান অর্থ এবং সময় ব্যয় করে তাকে জেল থেকে বের করে আনেন। এই ঘটনায় তার সহযোদ্ধার প্রতি ফিদেলের গভীর শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার প্রমান মেলে।


কিউবাতে আক্রমন করার জন্য ৬৩ ফুট লম্বা সাত কেবিনেটের একটি নৌকা কেনা হয়। নৌকাটির নাম ছিল ‘গ্রানমা’। ১৯৫৬ সালের ২৫ শে নভেম্বর গ্রানমায় চড়ে মেক্সিকো উপসাগরের টাক্সপান থেকে ৮২জন গেরিলা কিউবা অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। বিপ্লবিদের হিসেব মতে পূর্ব কিউবার দক্ষিন পশ্চিম প্রান্তের লা কলোরাডায় পৌছতে তাদের পাঁচ দিন লাগার কথা, তাই সেনাদের দৃষ্টি এড়াতে ৩০ নভেম্বর এক গনআন্দোলনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু খারাপ আবহাওয়ার কারনে বিপ্লবীরা গন্তব্যে পৌছেন ২রা ডিসেম্বর। ফলে গেরিলাদের পূর্ব পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। উপকূলে পৌছার সাথে সাথে গেরিলাদের উপর বিমান থেকে মেশিনগান দিয়ে আক্রমন করা হয়। পরে গেরিলারা সিয়েরা মায়েস্ত্রো পর্বতে গিয়েও মেশিনগানের আক্রমনে পরেন। চে গলায় ও বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন। ডিসেম্বরের শেষদিকে ৮২ জন গেরিলার মধ্যে শেষপর্যন্ত মাত্র ১৫ জন টিকে থাকে।


বিপ্লবী নেতা ক্যাস্ত্রো বাতিস্তা সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালানোর জন্য সিয়েরা মায়েস্ত্রো পার্বত্য অঞ্চলকে বেছে নেন। ৬,০০০ ফুট উচু এই পার্বত্য অঞ্চলটির বিশাল সবুজ বনাঞ্চল ছিল গেরিলাদের গা ঢাকা দিয়ে থাকার পক্ষে সম্পূর্ন উপযুক্ত। তারপর এখান থেকেই শুরু হল গেরিলাদের কঠিন, সংগ্রামী ও কষ্টকর বন্য জীবন। ক্রমাগত হেটে জঙ্গলের মধ্যেদিয়ে পথ করে এগিয়ে যাওয়া, অপ্রতুল খাবার আর ওষুধের অভাব এই নিয়ে ছিল গেরিলাদের নিত্যদিনের সংগ্রাম।


সিয়েরা মায়েস্ত্রার অধিকাংশ কৃষক চরম দারিদ্র সীমার নিচে মানবেতর জীবন যাপন করত। চিকিৎসা ও শিক্ষার সুযোগ বিহীন এসব মানুষের জীবন ছিল আদিম ও অন্ধকারাচ্ছন্ন। অপর পক্ষে বিদ্রোহী সেনারা ছিল শহুরে শিক্ষিত যুবক যাদের গ্রাম্য জীবন সম্পর্কে বাস্তব কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু দীর্ঘ সময় লাতিন আমেরিকায় ভ্রমনের অভিজ্ঞতার কারনে গ্রামীন জীবন ও মানুষের সঙ্গে চে’র পরিচয় ছিল। ফলে তিনি সহজেই সিয়েরা মায়েস্ত্রার দরিদ্র কৃষকদের কাছে গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠেন। তিনি গ্রামের লোকদের জন্য সাক্ষরতা অভিযান ও চিকিৎসা সেবা চালু করেন। ডাক্তার চে’র সুনাম দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

কিউবান বিপ্লবে চে’ ডাক্তার হিসেবে যোগদান করেন। গেরিলা ডাক্তারের ভূমিকা সম্পর্কে চে’ বলেন - “ডাক্তার (গেরিলা) পূর্নমাত্রায় একজন ধর্মযাজকের ভূমিকায় অবতীর্ন হন, যিনি তার সামান্য ঔষধপত্রের ব্যাগে মানুষের জন্য সান্তনা বয়ে বেড়ান। একজন রোগাক্রান্ত মানুষের কাছে একটি অ্যাসপিরিনের মূল্য কত তা হিসেব করে বলা যাবে না। বিশেষত সেটি যখন এমন বন্ধুত্বপূর্ন হাতে দেয়া হয় যিনি তাদের দুর্ভোগকে অনুভব করেন ও নিজের করে নেন”।

দেড় বছর ধরে সংগ্রামের পর ১৯৫৮ সালের ২১ শে জুন বিদ্রোহীরা এল জিগুতে এক বিশাল বিজয় অর্জন করেন। ২১ শে আগষ্ট ফিদেল চে’কে তার ৮ নং সেনাদল নিয়ে লাস ভিলাসের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেন। চে’র দলে সদস্য ছিল ১৪২ জন। কামিলো নেতৃত্ব দেন ২ নং সেনাদলকে। তিনি পশ্চিমের পিনাল দেল প্রদেশের দিকে ৮২ জন যোদ্ধা নিয়ে রওনা হন। চারদিনের মধ্যে গন্তব্যে পৌছার পরিকল্পনা থাকলেও ভ্রমনের জন্য নির্ধারিত ট্রাক গুলো ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় ঘোড়ায় চড়ে ,তিনটি মাত্র লন্ঠনের সাহায্যে পায়ে হেটে গন্তব্যে পৌছতে চে’র সেনাদলের ৪৭ দিন সময় লাগে। ১৬ অক্টোবর চে এস্কেমব্রে পর্বতে পৌছান। পরিকল্পনা ছিল সান্তাক্লারা দখলের মাধ্যমে দেশটিকে দুইভাগে ভাগ করে ফেলা।


চে ১৮ ডিসেম্বর ফোমেন্টোতে এবং ২৩ ডিসেম্বর প্লাসাটাসে গুরুত্বপূর্ন দুটি যুদ্ধ জয় করেন। চারদিন পর চে সান্তাক্লারায় পৌছান। ২৯ ডিসেম্বর চে বাহিনী হাভানা থেকে আগত সেনা ও অস্ত্র বোঝাই একটি রেলগাড়ি লাইন চ্যুত করে বিস্ফোরিত করে। ১ লা জানুয়ারি সান্তাক্লারা পদানত হয় এবং এর দুদিন পর চে হাভানায় উপস্থিত হন। হাভানা গেরিলাদের দখলে চলে যায়। সফল হয় কিউবান বিপ্লব। কিন্তু প্রকৃত বিপ্লব তখনো শেষ হয়নি। গেরিলাদের কর্তৃক হাভানা দখল ছিল মূলত বিপ্লবের শুরু। বিপ্লবীদের কাছে প্রাথমিক চ্যালেঞ্জ ছিল নতুন সরকার গঠন করা ও দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। পরাজিত সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে জনগনের মনে যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক আকাঙ্খা গড়ে উঠেছিল তা মেটানোর দায়িত্বও ছিল বিপ্লবীদের উপর।


১৯৫৯ এর জুনে চে’কে বিদেশ সফরে পাঠানো হয়। তিন মাসে তিনি ১২ টি দেশ সফর করে দেশে ফিরে ‘জাতীয় কৃষি সংস্কার ইনস্টিটিউটের’ অধীনে শিল্পায়নের দায়িত্ব গ্রহন করেন। নভেম্বরে চে সেন্ট্রাল ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট হন। পরের মাসেই তিনি কৃষি সংস্কার আইন পাস করেন, এর ফলে ৪০০ হেক্টরের অধিক কৃষিখামার গুলো দখলিচ্যুত হয়। ফলশ্রুতিতে ইউনাইটেড ফ্রুটের মত মার্কিন একচেটিয়া কোম্পানিগুলোর সম্পদ জাতীয়করন হয়ে যায়। ঠিক একই সময় কিউবার চিনির বিনিময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন অর্থঋন ও ভারী শিল্প তৈরীর প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসে। ফলে চে’কে মন্ত্রী করে শিল্পমন্ত্রনালয় স্থাপন করা হয়। এসব কারনে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কিউবার তিক্ততা বাড়তে থাকে যা অর্ধশতব্দী পর আজও বিদ্যমান।


বিপ্লব পরবর্তী এই সময়টিতে বিপ্লবকে সুসংহত করতে চে তার মন প্রান ঢেলে কাজ করেছেন । তিনি দিনে ১৬ থেকে ১৮ ঘন্টা কাজ করতেন। শুধু রবিবার বিকেলটা ছিল সন্তান ও পরিবারের জন্য। চে সবসময় দৃষ্টান্ত স্থাপনে বিশ্বাস করতেন। তাই তিনি মন্ত্রীর দায়িত্ব শেষে স্বেচ্ছা শ্রম হিসেবে আখ খামারে কাজ করতেন। তিনি জানতেন জনগনের কাছাকাছি পৌছুতে হলে নিজেকে তাদের একজন ভাবতে হবে, জানতে হবে তারা কি চায়, তাদের কি প্রয়োজন।


কিউবার মহান বিপ্লবকে চে লতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশে বিশেষ করে তার মাতৃভূমি আর্জেন্টিনাতে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন। তার জীবনের একমাত্র লক্ষ ছিল সাম্রাজ্যবাদের পতন ঘটানো এবং এর জন্য তিনি পৃথিবীর যেকোন স্থানে যুদ্ধ করতে প্রস্তুত ছিলেন।

১৯৬১ খৃষ্টাব্দে চে লাতিন আমেরিকায় বিপ্লব পরিচালনার জন্য গেরিলা যোদ্ধাদল সংঘটিত করতে শুরু করেন। সে সময় মুক্তিকামী লাতিন আমেরিকানরা দলে দলে হাভানায় আসতে শুরু করে। কিউবান সবকারও চে’র আগ্রহে আলজেরিয়া, নিকারাগুয়া, পেরু, গুয়েতমালা, ভেনিজুয়েলা ও আর্জেন্টিনার আন্দোলনে সহযোগিতা করতে থাকে। চে তখন চাইছিলেন লতিন আমেরিকা অভিযানে যেতে। কিন্তু সেখানে তখন গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য অনুকুল পরিবেশ ও পরিস্থিতি ছিল না। অপরপক্ষে কঙ্গোর মাটি ছিল গেরিলা যুদ্ধের জন্য সম্পূর্ন প্রস্তুত। তাই ফিদেলের অনুরোধে চে কঙ্গো যেতে রাজি হলেন। 


পরিকল্পনা ছিল চে কঙ্গো থাকাকালীন পিনেইরোর লোকেরা লাতিন আমেরিকাতে গেরিলা যুদ্ধের জন্য পরিবেশ তৈরী করে রাখবে। অপরদিকে চে’র গেরিলা যোদ্ধারা সেইসময় কঙ্গোতে সংঘর্ষের সময় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করবে এবং ভবিষ্যতের যুদ্ধের জন্য নিজেদের দূর্বলতা গুলো দূর করার সুযোগ পাবে। সেই সাথে লতিন আমেরিকার যুদ্ধের জন্য কারা উপযুক্ত চে তাদেরও বাছাই করতে পারবেন।


১৯৬৫ সালের ১লা এপ্রিল চে তার কঙ্গো অভিযানের জন্য ঘর ছেড়ে বেড়িয়ে পড়েন। আর ফিদেলের জন্য রেখে যান তার সেই ঐতিহাসিক চিঠি। আবেক ভারাক্রান্ত সেই চিঠিতে চে লিখেছেন “আমি পার্টি নেতৃত্ব থেকে পদত্যাগ করছি, আমার মন্ত্রীর পদ, কমান্ডারের পদবি এবং কিউবার নাগরিকত্ব ত্যাগ করছি। কিউবার সঙ্গে আমার কোন আইনি সম্পর্কই থাকলো না, টিকে রইলো শুধু সেই বন্ধন যা আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ করা যায় না।” চে আরো লিখলেন “অন্যকোন ভূমি, অন্যকোন দেশ আমাকে আহবান করছে যথাসাধ্য কাজের জন্য। সে আহবানে আমি সাড়াদিতে পারি, কিউবার অগ্রনায়কের দায়িত্ব পালনের কারণে তুমি তা পার না। তাই আমাদের বিচ্ছেদের সময় ঘনিয়ে এসেছে”। কিউবা ছেড়ে যাওয়ার সময় চে তার স্ত্রী ও সন্তানদের জন্য কিছুই রেখে যেতে পারেননি এবং এর জন্য তার কোন দুঃখও ছিল না কারন তিনি জানতেন ওদের খাওয়াপরা ও শিক্ষার ভার রাষ্ট্রই নেবে।

১৯৬৫ সালের ১৯ শে এপ্রিল চে মস্কো, কায়রো ইত্যাদি শহর ঘুরে এসে নামেন দার-এস-সালামে। অবশ্য তখন তাকে চে হিসেবে চেনার কোনো উপায় নেই। মসৃনভাবে দাড়ি কামানো, চোখে সুদৃশ্য চশমা পড়া র‌্যামন বেনিৎজ্ নামে চে কঙ্গোতে প্রবেশ করেন। তবে চে কঙ্গোতে ছিলেন মাত্র ছ’মাস। কঙ্গোর স্থানীয় কমিউনিস্ট পর্টি সহযোগিতা না করায় এবং স্থানীয় ভাষা ও মানুষের চরিত্র বুঝে উঠতে না পারায় চে’র কঙ্গো অভিযান পুরোপুরি ব্যর্থ হয়। তিনি অভিযানের ব্যর্থতা স্বীকার করে গেরিলা বহিনীকে দেশে ফেরত পাঠান। আর প্রাগ হয়ে হাভানায় ফিরে আসার পথে ডায়রিতে লিখেন, “যে জতির স্বাধীনতা সংগ্রামে মনোবৃত্তি নেই আমরা তাদের মুক্ত করতে পারি না।”


চে সত্যিকার মার্ক্সবাদীদের মত আত্মবিশ্লেষন করতেন। নিজের ভুলগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বিশ্লেষন করে লিখে রাখতেন। কঙ্গোর ব্যর্থতার কারন বিশ্লেষন করে তিনি বই লিখেছেন যার নাম তিনি দিয়েছেন ‘পর্সাজাস ডি লা গুয়েরা রেভ্যুলুসানিয়া কঙ্গো’, প্রথম পাতায় লিখেছেন ‘ব্যর্থতার ইতিহাস’।
চে’র পরবর্তী গন্তব্য ছিল বলিভিয়া। বলিভিয়ার উদ্দ্যেশে কিউবা ছেড়ে যাওয়ার আগে চে’ তার স্ত্রী আলাইদা ও তার সন্তানদের সাথে দেখা করার জন্য আসেন। পরিচয় প্রকাশ হয়ে যাওয়ার ভয়ে চে তার সন্তানদের কাছে নিজেকে তাদের পিতার বন্ধু র‌্যামন বলে পরিচয় দেয়।

সিআইএ’র চোখে ধুলো দেয়ার জন্য চে মস্কো, প্রাগ, প্যারিস, মাদ্রিদ, সাও পাওলো হয়ে ১৯৬৬ সালের ৩ রা নভেম্বর বলিভিয়ার রাজধানী লাপাজে এসে পৌছেন। বলিভিয়া ছিল লাতিন আমেরিকার কেন্দ্রে, তাছাড়া তখন পর্যন্ত গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য বলিভিয়ার মাটিই ছিল সবচেয়ে উপযুক্ত, তাই বিপ্লব পরিচালনার জন্য বলিভিয়াকে বেছে নেয়া হয়। ফিদেল ক্যাস্ত্রোর নির্দেশে আগে থেকেই বলিভিয়ার দক্ষিন পূর্ব অঞ্চলে প্রায় দেড় হাজার হেক্টরের বনভূমিতে একটি পশুখামার গড়ে তোলা হয় যার আড়ালে চে তার লাতিন আমেরিকার গেরিলাদের প্রশিক্ষন দেবেন বলে ঠিক হয়। বন জঙ্গলের আড়ালে গেরিলাদের বেস ক্যাম্পটি ছিল খুব সাদামাটা। সেখানে ছিল কাদামাটির তৈরী উনুন, হাতে তৈরী কাঠের টেবিল ও বেঞ্চ। মাটি খুড়ে তৈরী করা হয়েছিল পায়খানা। অস্ত্রশস্ত্র, ওষুধ ও নথিপত্র রাখা হতো হাতে তৈরী সুরঙ্গে। চে তার এই বিবর্ন ক্যাম্পে বসেই স্বপ্ন দেখতেন একদিন বলিভিয়ার বিপ্লব দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়বে লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশে। বিপ্লবের সেই আগুনে পুড়ে ছাড়খার হবে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। বলিভিয়া হবে আরেকটি ভিয়েতনাম।

তবে চে’র এই স্বপ্ন সত্যি হয়নি। দুঃখজনক ভাবে বলিভিয়ার কমিউনিস্ট পার্টি চে’র গেরিলা যুদ্ধের কৌশলকে সমর্থন করেনি। বিশেষ করে পার্টির সেক্রেটারী মোঞ্জের বিশ্বাসঘাতকতা, বলিভিয়া সেনবাহিনীর আতর্কিত আক্রমন, স্থানীয় কৃষকদের অসহযোগিতা, রসদ ও ওষুধপত্রের অপ্রতুলতা ইত্যাদি বিভিন্ন কারনে চে’র বলিভিয়ার বিপ্লব ব্যর্থ হয়।

দীর্ঘ ১১ মাস সংগ্রামের পর ১৯৬৭ সালের অক্টোবরের শুরুতে চে’র গেরিলারা অসুস্থ হয়ে পরলো। চে নিজেও তখন অনেক অসুস্থ। ওষুধ আর খাবারের অভাবে গেরিলাদের অবস্থা মৃতপ্রায়। এমন অবস্থায় ৭ ই অক্টোবর গেরিলা দল লা হিগুয়েরার কাছেই এক গিরিখাতে অবস্থান নেয়। দলে তখন মাত্র ১৭ জন গেরিলা। ৮ ই অক্টোবর গেরিলারা সেনাবাহিনী দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে পড়লে যুদ্ধ করে সেনাদের কেটে বেরিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। যুদ্ধ শুরু হলে কিছুক্ষনের মধ্যে চে’র কার্বাইনের ব্যারেলে গুলি লাগলে কার্বাইনটি অকেজো হয়ে পরে। দ্বিতীয় গুলিটি লাগে চে’র বা পায়ে। চে’র পিস্তলের ম্যাগজিনের গুলিও তখন শেষ। সম্পূর্ন নিরস্ত্র ও অসহায় অবস্থায় চে পালিয়ে বাঁচার চেষ্টা করেন। কিন্তু অল্প সময় পরেই আহত অবস্থায় চে ও তার সঙ্গী উইলি ধরা পড়েন। তাদের নিয়ে যাওয়া হয় লা হিগুয়েরাতে। ৮ ই অক্টোবর বলিভিয়া সেনাবহিনীর কর্নেল সেলিচ ও ৯ ই অক্টোবর সিআইএ এজেন্ট, এক দেশত্যাগী কিউবান ফেলিক্স রড্রিগ চে’কে জেরা করে। তাদের পরবর্তী স্বীকারোক্তি অনুযায়ী চে তাদের সম্পূর্ন উপেক্ষা করেছিলেন এবং লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে বিপ্লব সফল হবে বলে তিনি দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন।



বলিভিয়ান হাই কমান্ড থেকে চে’কে হত্যার নির্দেশ আসে। মেজর মিগুয়েল আইয়ো ও কর্নেল সেলিচ চে’কে হত্যা করার জন্য নন কমিশন্ড অফিসার মারিও টেরানকে আদেশ দেয়। মদ্যপ টেরান চে’র কোমরের নিচে তাক করে গুলি করে। গুলি করার পর চে’ আরো ঘন্টাখানেক বেঁচে ছিলেন। চে’কে যন্ত্রণা দেয়ার জন্যই ওর মাথায় বা বুকে গুলি না করে কোমরে গুলি করা হয়েছিল। এভাবে পরিকল্পিত ভাবে চে’র মৃত্যু যন্ত্রনাকে র্দীঘায়িত করা হয়। পরে এক মদ্যপ সার্জেন্ট পিস্তল দিয়ে বুকের বাঁদিকে গুলি করে এই মহান বিপ্লবীকে হত্যা করে। মৃত চে’র দৃষ্টান্তমূলক শক্তির ভয়ে সামরিক কর্মকর্তারা চে ও অন্য গেরিলাদের গোপনে গনকবর দেয়। কবর দেয়ার পূর্বে চে’র দেহ থেকে ওর হাত বিচ্ছিন্ন করে রাসায়নিকের বোতলে ডুবিয়ে রাখে। চে’র মৃতদেহকে বিকৃত করে শত্রুরা বর্বরতার শেষ সীমাও লঙ্ঘন করে ফেলে। আসলে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চরিত্রটাই এমন। ওরা পৃথিবী জুড়ে মানবাধিকার ও শান্তির বার্তা প্রচার করে আর খনিজ তেল ও অস্ত্র বিক্রির স্বার্থে দেশে দেশে যুদ্ধ ও গনহত্যা চালিয়ে যায়।


সাম্রাজ্যবাদী শক্তি চেয়েছিল চে’কে হত্যা করে চে’র আদর্শকে এই পৃথিবী থেকে মুছে দিতে। কিন্তু চে’কে দৈহিক ভাবে হত্যা করা সম্ভব হলেও তার আদর্শকে ধ্বংস করতে পারেনি লুটেরা শক্তি। আজো পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ শ্রমজীবী ও মুক্তিকামী মানুষ চে’র আদর্শকে ধারন করে। চে’র দ্বারা অনুপ্রানিত হয় শোষিত মানুষ, জন্ম হয় হুগো শ্যাভেজ বা ইভো মোরালেসদের মত নেতাদের। চে’র আদর্শ দ্বারা অনুপ্রানিত হয়েই একদিন পৃথিবীর বুকে প্রতিষ্ঠিত হবে শোষনহীন মানবিক সমাজ। চে বেঁচে থাকবেন গনমানুষের হৃদয়ে।

               “...............................
                 তিনি মৃত তবু জীবিতের চেয়ে
                 অনেক সজীব এবং কান্তিমান
                 ভবিষ্যতের জন্য হেলায়
                 দিয়েছেন ছুড়ে আপন বর্তমান।
                 বুলেট বিদ্ধ মোহন গেরিলা
                 প্রসারিত আজ নিখিল ভূমন্ডলে।
                 লেখার টেবিলে, কপাটে, দেয়ালে
                 চে গুয়েভারার সুবিশাল চোখ জ্বলে।” (চে গুয়েভারার চোখ, শামসুর রাহমান)

তথ্যসূত্র:
১.      চে হ্যান্ডবুক - হিলদা বারিও
                   গ্যারেথ জেনকিনস (অনুবাদ: শফিকুল ইসলাম)
২.      স্মৃতিকথায় কিউবা বিপ্লব - চে গুয়েভারা (অনুবাদ: অশেষ রায়)
৩.      চে’র শেষের দিনগুলো ও বলিভিয়ার ডায়েরি - পরিতোষ মজুমদার
৪.      চে গুয়েভারাকে নিয়ে কবিতা (অনুবাদ: পারভেজ চৌধুরী)



মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৩

কোটা প্রথা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা


সরকারী চাকরিতে কোটা বরাদ্ধ নিয়ে দেশে ইদানিং একটি বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে । বাংলাদেশে সরকারী চাকরি অর্থ্যাৎ পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক গৃহীত পরীক্ষায় মোট ৫৫ % আসন সংরক্ষিত থাকে। আর বাকি ৪৫% আসন বরাদ্ধ থাকে মেধা তালিকায় স্থান পাওয়াদের জন্য।

আপাত দৃষ্টিতে দেখলে ব্যাপারটা খুব অসামঞ্জস্যপূর্ণ মনে হয়। কারন পৃথিবীর কোথাও কোনো প্রতিযোগীতামূলক পরীক্ষায় অর্ধেকের বেশী আসন সংরক্ষিত থাকেনা। আর বাংলাদেশের মত পরিস্থিতিতে যেখানে বেকারত্বের হার অনেক বেশী আর চাকরি যেখানে সোনার হরিণ সেখানেতো এই ব্যবস্থাটাকে রীতিমত পরিহাস মনে হয়। কিন্তু ব্যাপারটা যত সরল মনে হয় বাস্তবে ততটা নয়। কারন ৫৫% কোটার মধ্যে ৩০% কোটা বরাদ্ধ থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানদের জন্য। তাই এই ব্যবস্থার বিরোধিতা করলে প্রথমেই মনে এই প্রশ্ন জাগে, কোটা প্রথার বিরোধিতা করা কি প্রকারন্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থ্যাৎ মুক্তিযুদ্ধের চেতনারই বিরোধিতা করা নয় কি?

এই বিষয়ে আলোচনার আগে ভালো করে ‍বোঝা দরকার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলতে আমরা আসলে কি বুঝি। ১৯৭১ এ সংগঠিত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ছিল একটি শ্রেণী বৈষম্যহীন, সমঅধিকার ভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক মানবিক দেশ গড়া। মুক্তিযোদ্ধারা কেউই ব্যক্তিগত সুযোগ সুবিধা বা ভবিষ্যৎ চিন্তায় যুদ্ধ করেননি। বরং বলা ভালো দেশের জন্য তারা তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ দুটোকেই বিপন্ন করেছিলেন। এখন দেশের মধ্যে মুক্তিযোদ্ধাদের আলাদা সুযোগ সুবিধা দেওয়ার মানেই হলো মুক্তিযোদ্ধারা যে ধরনের দেশ চেয়েছিলেন তা বিপরীতে কাজ করা। অনেকে বলতে পারেন বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধারা যে ধরনের মানবেতর জীবন ধারণ করেন তাদের জন্য কি আমাদের কিছু করার নেই। এধরনের চিন্তা যারা করেন তাদের বুঝতে হবে মুক্তিযোদ্ধারা করুণার পাত্র নয়। দেশের জন্য যারা নিজের জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন আজ আমরা তাদের জন্য মাসিক ভাতা, কোটা ইত্যাদি দিয়ে যতটা না সম্মান দিচ্ছি তার চেয়ে বেশী অপমান করছি। আমরা এটা কেনো চিন্তা করি না ৪২ বছরে আমরা কেমন দেশ গড়লাম যেখানে সকলের সমঅধিকার তো দূরের কথা মুক্তিযোদ্ধাদেরই করুণার পাত্র হতে হয়।

তাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শভিত্তিক দেশ গড়তে হলে দেশ থেকে এই ধরনের বৈষম্যমূলক প্রথা বাতিল করে মেধা বিকাশের সুষ্ঠ পরিবেশ গড়ে তুলতে হবে। তবেই দেশ মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের পক্ষে একপা এগিয়ে যাবে। তখন দেশের আর সবার সন্তানের মত মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানরাও সঠিক ভাবে শিক্ষিত হয়ে যোগ্যভাবে বেড়ে উঠবে।


শুক্রবার, ১৬ আগস্ট, ২০১৩

সানি লিওন আতঙ্ক ও আমাদের ভোগবাদ

সাম্প্রতিক ঈদের আগে আমাদের দেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল সানি লিওন। সানি লিওন হচ্ছে কানাডার সাবেক পর্ণো চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী বছর খানেক আগেই যার বলিউডে অভিষেক হয়েছে। তবে আমাদের আলোচিত সানি লিওন কিন্তু ব্যক্তি সানি লিওন নয়। ঈদের আগে বাংলাদেশে তার নামে একটি পোষাক এসেছিল ভারত থেকে, যা পুরো বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত সমাজের ভিতকে একটা জোড়েসোরে ঝাকুনি দিয়েছে।




কি ছিল সেই পোষাকে যাতে তা নিয়ে পুরো দেশে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। ঝড় উঠলো সোস্যাল মিডিয়াতে। এমন কি এই পোষাক নিয়ে অনেক ধরনের মজার মজার কৌতুকও চালু হয়েছে। যেমন দোকানদার তার বন্ধুকে বলছে জানিস আজ একজন সানি লিওনের ড্রেস কিনতে এসেছিল, আমি তাকে একটা খালি প্যাকেট ধরিয়ে দিয়েছি, হা হা হা।


না এই পোষাক নিয়ে সোস্যাল মিডিয়াতে যে ধরনের হাসি তামাশা বা কৌতুক হয়েছে বাস্তবে পোষাকটি অতোটা অশ্লীল ছিল না। সমস্যাটি পোষাকের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ বা দাম নিয়ে নয়। সমস্যা হচ্ছে পোষাকটি এমন এক সেলিব্রেটির যার পেশাকে আমরা আমাদের ভদ্র সমাজে স্বীকৃতি না দিলেও আমাদের সমাজ তাকে টিকিয়ে রেখেছে যুগের পর যুগ ধরে।
 
সানি লিওন পর্ণোগ্রাফীর অভিনেত্রী বা সোজা বাংলায় সে দেহজীবি। তবে এই দেহজীবি আর সংসদ ভবনের সামনে সস্তা প্রসাধনী মেখে খদ্দেরের অপেক্ষায় দাড়িয়ে থাকা দেহজীবি এক জিনিস নয়। এ খোদ কানাডা থেকে আমদানি করা আধুনিক এক ব্রান্ডেড পণ্য যার শিল্পকর্ম দেখতে সহজ সরল ভেতো বাঙ্গালীরাও হুমড়ি খেয়ে পড়ে।

আর তাই বাংলাদেশে যখন সানি লিওনের প্রথম বলিউড ফিল্ম   জিসম-টু পাইরেটেড হয়ে চলে আসে তখন সেটা নিয়ে সমালোচনার বদলে চলতে থাকে হট কেক বা গরম পিঠের মত কাড়াকাড়ি। অনুসন্ধিৎসু বাঙ্গালীর মন তখন জানতে চায় সানি লিওনের ন্দি সিনেমায় অভিনয় করা কি পিএইচডি করার পর এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়া না এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার সমতুল্য।



তাহলে প্রশ্ন দাড়াচ্ছে সানি লিওনের নামের পোষাক নিয়ে বাঙ্গালীর মনে এত আতঙ্ক কেনো। আসলে সে অতঙ্কের মূল কারন হচ্ছে আমাদের পুরোনো জং ধরা পুরুষতান্ত্রিক ভোগবাদী মন। যতক্ষন সানি লিওন আমাদের মনোরঞ্জন করছে বা ম্যাড়মেড়ে জীবনে একটু ঝাকি দিচ্ছে ততক্ষন সব ঠিক আছে। আমাদের ভোগবাদী মন আতঙ্কগ্রস্থ হয় তখনই যখন সানি লিওন আমাদের ভোগের চৌহদ্দি পেরিয়ে ব্যক্তি জীবনে ঢুকে পড়ে।

আমাদের স্ত্রী বা বোনকে সানি লিওনের পোষাকে (তার দৈর্ঘ্য যতই হোক নামতো সানি লিওন) কল্পনা করে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক মনে আতঙ্কের শীতল স্রোত বয়ে যায়। আমাদের মনে পড়ে যায় সানি লিওনকে ঘিরে পুরুষদের অবদমিত ভোগবাদী চিন্তাগুলো, যা হয়তো অন্য কেউ আমার বোন বা মেয়েকে নিয়ে ভাবতে পারে। তাই আমাদের ভীতু মন তখন সানি লিওনের ফ্যান্টাসিকে ভুলে তাকে উচ্ছেদ করতে প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠে। আমরা একবারও ভেবে দেখি না এভাবে সানি লিওনকে তাড়ানো গেলেও তার ভূত কিন্তু ঠিকই রয়ে যাবে আমাদের ঘাড়ে চেপে।



তাহলে আমাদের কি করা উচিত। ভিনদেশ থেকে এভাবে সানি লিওন, ক্যাটরিনা, কারিনা নামক বিভিন্ন উচ্চ শ্রেনীর দেহজীবিদের নামে আমাদের দেশে বিভিন্ন পোষাক আমদানি হবে, তা নিয়ে সারাদেশে কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে যাবে, আর আমরা শুধু বসে বসে দেখবো। না এটাও কোনো সমাধান নয়। এর প্রতিবাদ অবশ্যই করতে হবে। তবে প্রতিবাদের আগে প্রতিবাদের উদ্দেশ্যটা আগে ভালোভাবে বুঝতে হবে। আমাদের প্রতিবাদের উদ্দেশ্য কি শুধুই সানি লিওন নামক ব্যক্তি বিশেষের বা তা বিশেষ পোষাকের বিরুদ্ধে। নাকি এই ধরনের সানি লিওন, ক্যাটরিনা, কারিনা ও দিপীকাদের নিয়ে গড়ে উঠা একধরনের ভোগবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে, যা নারীকে মানুষের পর্যায়ে না রেখে নামিয়ে আনে দোকানের দামী পন্যের তালিকায়।



যদি এই ভোগবাদী সংস্কৃতির বিপক্ষেই আমাদের প্রতিবাদ হয় তাহলে আমাদের বলতে হবে আমরা এই পুরো সংস্কৃতিরই অবসান চাই যা আমাদের মা, বোন, কন্যাদের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। এই সংস্কৃতিটি এতোই ভয়াবহ যে তা আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয় আধুনিক মেয়ে মানেই দৈহিকভাবে আকর্ষনীয় হতে হবে। অর্থ্যাৎ তাকে শুধু সুন্দর হলেই হবে না তাকে আবেদনময়ী হতে হবে। আর যার প্রশিক্ষনের জন্য দেশব্যাপী তথা পুরো বিশ্বব্যাপী চলছে সৌন্দর্য প্রতিযোগীতার নামে রমরমা স্বীকৃত যৌন ব্যবসা। যেখানে প্রধান পন্য হচ্ছে নারী। সেখানে বিচার হয় কে নিজেকে কতটা আকর্ষনীয় ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে অর্থ্যাৎ নিজেকে কে সুন্দর পন্য হিসেবে জাহির করতে পারে। আর যারা নিজেকে সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে তাদের জন্য আছে বিচারকের বিভিন্ন যৌন সুরসুরি যু্ক্ত প্রশংসামূলক বাক্য।

এই সংস্কৃতির প্রভাব যে শুধু অভিনয় বা বিজ্ঞাপন জগতে আছে তা কিন্তু নয়। এই ভোগের ডামাডোলে পড়ে এখন গানও শোনার বস্তু থেকে দেখার বস্তু হয়ে গেছে। তাই স্যাটেলাইটের বদৌলতে এখন বাঙ্গালী গানের মাধ্যমে জানতে পারে ‘চামেলী কত চিকনি’ বা ‘শিলার যৌবন’ কতটা উদ্দীপক। ‘মুন্নীর কেনো বদনাম’ হলো তা নিয়েও আমাদের মাথা ব্যাথা কম নয়। তো এভাবে একদিকে ‘উ লা লা উ লা লা’ সংস্কৃতি চালু করে রেখে অপরদিকে কোনো ভাবেই সানি লিওনদের আগমনকে ঠেকানো যাবে না। কোনো না কোনো রুপে তা আমাদের সমাজে প্রবেশ করবেই। আর তার আঘাত বিষাক্ত সাপের ছোবলের চেয়ে কোনো অংশে কম হবে না। সে লক্ষন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যেখান থেকে এইসব অপসংস্কৃতি আমাদের দেশে প্রবেশ করেছে সেখানে খুব ভয়াবহ ভাবে দেখা দিয়েছে। বাসে মেডিকেল ছাত্রীকে ধর্ষণ করে হত্যা করা কি শুধুই কিছু ব্যক্তিবিশেষের দ্বারা সংঘটিত বিছিন্ন ঘটনা নাকি তার পেছনে পুরো ভারত জুড়ে চলা নারীকেন্দ্রিক অশ্লীল বিনোদনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব আছে তা নিয়ে এখন ভারতের সমাজ বিজ্ঞানীরা নতুন করে ভাবছে।


আমাদেরও নতুন করে ভাবতে হবে। ভাবতে হবে আমরা আমাদের দেশের নারীদের কিরুপে দেখতে চাই। আমাদের কন্যাদের কি আমরা আবেদনময়ী, নির্বোধ ও পুরুষের ভোগের বস্তু হিসেবে দেখতে চাই নাকি তাদের মননশীল, সৃজনশীল ও মানবিক বোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে দেখতে চাই। আমাদের মেয়েদের আদর্শ কে হবে, প্রীতি লতা ও বেগম রোকেয়া নাকি ‘চিকনি চামেলী’ ও ‘শিলা কি জাওয়ানী’ খ্যাত ক্যাটরিনা তা আমাদেরই ভাবতে হবে। আর এই ভাবনাটা যত দ্রুত করা যায় ততই ভালো, তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে আর সানি লিওনদের আমদানি করতে হবে না। আমাদের কর্পোরেট বিনোদন জগত তখন দেশেই সানি লিওন তৈরী করে বিদেশে রপ্তানী করবে।



শুক্রবার, ২ আগস্ট, ২০১৩


বাংলাদেশের একটি বহুল প্রচলিত দৈনিকের গত ২৬/০৭/২০১৩

 প্রতিদিন না খেতে পাওয়া  হাজারো শিশুর একজন

তারিখের সংখ্যায় ১২ নং পাতার সম্পাদকীয়তে প্রখ্যাত সাংবাদিক ও লেখক ফারুক ওয়াসিফ এর "ব্রিটিশ রাজপুত্র বনাম আমাদের সম্রাট" লেখাটি আমার নজরে পড়ল। সম্প্রতি তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা সকলেই জানি যে ব্রিটিশ রাজ পরিবারের ৩য় উত্তরাধিকারি হয়ে নতুন শিশুর আগমন হয়েছে। এ নিয়ে আমাদের দেশের গণ মাধ্যম সহ সারা বিশ্বের মিডিয়াতে চলছে ব্যাপক মাতামাতি। উল্লিখিত সম্পাদকীয়তে লেখক চমৎকার ভাবে শুরু করেছেন এই বলে - "একটি শিশু জন্মাল, একটি শিশু মরে গেল। একজন রাজপুত্র, অন্যজন হতভাগ্য। একজন রাজবধূ, অন্যজন দরজির বউ। একজন রাজ রানী, অন্যজন ঘুটেকুরানী। একজনের ঠাটবাটের খরচ যোগায় রাষ্ট্র, অন্যজন অভাবের জ্বালায় আত্মঘাতী মায়ের হাতে মরে যায়। অঙ্কের হিসাবে এক থেকে এক বাদ গেলে শুন্য থাকার কথা। কিন্তু সব শিশু তো সমান না। বিশ্বে প্রতিদিন মরে যাওয়া ২৫ হাজার শিশুর ( ৫ বছরের কম বয়সী) চেয়েও দামী একটি শিশুর জন্ম। বিশ্বে প্রতিদিন মারা যায় ৩ লাখ ৩৭ হাজার শিশু!
রাজশিশু আলেকজান্ডার লুইস
এই ঘটনা বিশ্ব কে নাড়া দেয় না। কিন্তু ব্রিটিশ রাজপুত্রের জন্ম সংবাদে বিশ্বব্যাপী মাতোয়ারা লেগে যায়"

ওদিকে বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় নাসিরনগর উপজেলার হরিপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত গ্রাম আলিয়ারায় দারিদ্র্যের কষাঘাতে পিষ্ট মা রোমেনা অভাবের তারনায় তার দুই পুত্র সম্রাট ও তাজিন কে নিয়ে পানিতে ঝাপ দিয়েছেন। ২৩ জুলাই ইফতারী নিয়ে শাশুড়ীর সাথে রোমেনার কলহ হয়,পরদিন তিনি সন্তানদের নিয়ে পানিতে ঝাপ দেন। কই, আমাদের দেশের মিডিয়া তো এই খবর টা ব্রিটিশ রাজপুত্রের আগমনের খবরের মত ফলাও করে প্রচার করলো না?

পত্রিকার পাতা খুললেই আজকাল আমরা দেখি রকমারী ইফতারীর বাজার, নানা ইফতার মাহফিলের খবর। পাশাপাশি আমরা দেখি নানা রকমারি, সুস্বাদু , উপাদেয় ইফতারের বর্ণনা। দৈনিক ৬-৭ টা বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে আমরা দেখি দেশের এক স্বনামধন্য মিডিয়া ব্যক্তিত্বকে কত রকম উপায়ে স্যুপ বানানো যায় তা বর্ণনা করতে। এর পাশাপাশি সব চ্যানেল গুলো তে বিভিন্ন তারকারা বিভিন্ন রকম ইফতারী তৈরীর প্রক্রিয়া দেখান। কিন্তু আমাদের দেশের প্রতিদিন না খেতে পেয়ে যে হাজারো শিশু মারা যায়, হাজারো মা নিজ হাতে স্বন্তান কে হত্যা করতে বাধ্য হয় তা তো কোথাও প্রচার হয় না। একদিকে মানুষ না খেয়ে মরে, অন্যদিকে আমাদের গণ মাধ্যম কোথায় কোন আহামরি ইফতার পাওয়া যায় তার খবর প্রচার করে, আর বিত্তশালীরা ছুটে যায় সেই সব ইফতার কিনতে। আমাদের গণ মাধ্যম করবে আমাদের গণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব, তা না করে এরা করছে মুষ্টিমেয় কিছু করপোরেট গোষ্ঠীর দালালি।

যেই ব্রিটিশ রাজপুত্রের জন্ম নিয়ে এত মাতামাতি সেই ব্রিটিশরাই আমাদের ২০০ বছর ধরে শাসন আর শোষণ করেছে। সেই শাসনামলেই আমরা দুই দুই বার দুরভিক্ষের স্বীকার হয়েছি। এখন তাদের নিয়ে মিডিয়ার মাতামাতি কি এটাই বলে না যে আমরা আজো ওই ব্রিটিশদের নিজেদের প্রভু মানি আর তাদের চাটুকারী করি? সেই ব্রিটিশদের ভবিষ্যত শাসককে কি আমরা এখনো আমাদের ভবিষ্যত শাসক বলে মনে করি!?

ঠিক একই ভাবে বিশ্ব মিডিয়াও সমগ্র বিশ্ব জুড়ে প্রতিনিয়ত মারা জাওয়া লাখ লাখ মানুষের খবর না রেখে ব্রিটিশ রাজপুত্রের জন্মগ্রহণের সংবাদ নিয়ে মাতোয়ারা। ঠিক যেমন টা ছিল উল্লিখিত রাজপুত্রের পিতার বিয়ের সময়।

একদিকে পত্রিকায় সম্পাদকীয়তে লেখক ফারুক ওয়াসিফের এমন জীবন ঘনিষ্ঠ লেখা, অন্যদিকে সেই "রাজশিশুর নাম কেন আলেকজান্ডার লুইস?" ছেপে এরা কীসের পরিচয় দিচ্ছে? এই সম্পাদকীয় কি শুধু তাহলে ধারাবাহিক ভাবে রাজশিশুর খবর প্রচারের জন্য ক্ষমা চাওয়ার উদ্দেশ্যে প্রকাশ? নাকি নিজেদের মানসিক সন্তষ্টি? নাকি সাধারণ মানুষের চোখে ধুলো দেয়ার অপচেষ্টা মাত্র? আর আমরাই বা কেন এই দুমুখো মিডিয়ার প্রচারে নীরব থাকি?

বৃহস্পতিবার, ১ আগস্ট, ২০১৩

সংস্কৃতির দুটি কথা



ms¯‹…wZ kãwU AvR †_‡K A‡bK eQi Av‡MI Avgv‡`i Kv‡Q ARvbv wQj| ms¯‹…wZi Av‡M Avgv‡`i †`‡k †hUv †ekxi fvM cÖPwjZ wQj, †mwU n‡”Q K…wó ev KvjPvi| fvlvwe Wt mywbwZ Kzgvi PÆcva¨vq 1921 mv‡j d«v‡Ý †Kvb GKUv Abyôv‡b †hvM †`qvi Rb¨ †mLv‡b wM‡q wQ‡jb| †mB Abyôv‡b e³viv e³…Zv †`Iqvi mgq Òms¯‹…wZÓ K_vwU D‡jL KiwQ‡jb †mLvb †_‡K G‡m Wt mywbwZ Kzgvi PÆcva¨vq iex›`ªbv_ VvKzi Gi g‡a¨ ms¯‹…wZ wel‡q Avjvc Av‡jvPbv nq| Zv‡`i `yB R‡bi  K‡_vcK_‡bi djশ্রুতিতে AvR‡Ki GB ms¯‹…wZ k‡ãi আর্বিভাব।GLb Avi †KD K…wó kãwU e¨envi K‡i bv| GLb mevB ms¯‹…wZ kãwU e¨envi K‡i|
Zvn‡j Av‡mb, ms¯‹…wZ ej‡Z Avgiv wK eywS? eZ©gvb mg mvgwqK প্রক্ষাপটে ev eZ©gvb mgv‡R ms¯‹…wZ ej‡Z hvnv eySvq †mUv n‡jv `yÕPviUv Mvb, †mB mv‡_ Zejv I nvigwbqv‡gi mswgkÖYB AvR‡Ki ms¯‹…wZ, A_ev †Kvb K¬v‡e ev A‡civ nvD‡R e‡m bv, Mvb Ges Acms¯‹…wZi mv‡_ cvল্লা w`‡q GwM‡q Pjv| G‡Zv †Mj ms¯‹…wZi bv‡g GKai‡bi †fvM, wejvwmZv ev e¨w³K fvj _vKv, GKv †L‡q †e‡P _vKvi gbbkxjZvi PP©v Kiv| Avevi eZ©gvb mgv‡R wKQz gvbyl Av‡Qb hviv cÖMwZkxj avivq KvR Ki‡Z‡Q Zv‡`i wn‡m‡e ms¯‹„wZ ej‡Z ‡hUv eySvq †mUv n‡”Q mKv‡j Nyg †_‡K DVv †_‡K ïiæ K‡i iv‡Î Nygv‡bvi Av‡M ch©šÍ ‡h mg¯Í Kg©KvÛ msNwUZ nq †mwUB n‡”Q ms¯‹„wZ| LvIqv, Nygv‡bv, AvPvi, e¨envi, wek¦vm, Awel¦vm, ivM, weivM, nvwm-Kvbœv BZ¨vw` ms¯‹…wZi g‡a¨ AšÍf©y³| Avgvi ms¯‹„wZ Avi GKRb D”PweË gvby‡li ms¯‹…wZ wKš‘ GK bq|
Rxeb msMÖv‡gi avivevwnKZvq hw` gvby‡li ms¯‹…wZ‡K hw` cwieZ©b Kiv bv hvq, Zvn‡j mvgwMÖKfv‡e cwieZ©b Kiv m¤¢e bq


শুক্রবার, ৩১ মে, ২০১৩

পরিবর্তনঃ কেন চাই? কিভাবে চাই


চারপাশে শুধু একটাই কথা পরিবর্তন চাই পরিবর্তন । সবাই পরিবর্তন চায়। অলিতে, গলিতে,  পাড়া, মহল্লায়, চায়ের আড্ডায়, সোশ্যাল মিডিয়া, ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু হচ্ছে পরিবর্তন। কেউ কেউতো আবার পরিবর্তন নিয়ে “বদলে দাও, বদলে যাও” নামে কর্পোরেট প্রজেক্ট চালু করে ফেলেছে। সেদিন একজন বলছিলেন ‘ভাই দেশটার অবস্থা ভালো না পরিবর্তন দরকার’, ওনার পরিবর্তন দরকার কারন দেশের এই অস্থিতিশীল অবস্থায় ওনার গাড়ি বিক্রির ব্যবসাটা ভালো চলছে না। এখন কেউ গাড়ি কেনার ঝুকি নিতে চায় না। কখন কে গাড়িতে আগুন দিয়ে দেয় তাই। মিডিয়াতেও এখন পরিবর্তনের ঢেউ চলছে। ভারতীয় সিরিয়ালের সাথে টেক্কা দিতে একজন সিনিয়র অভিনেত্রী ফর্মুলা নিয়ে এলেন, এখন থেকে ওদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হলে আমাদের ওদের মতোই মসলাদার সিরিয়াল বানাতে হবে। তো শুরু হয়ে গেলো নাট্য জগতে পরিবর্তন। নাটকের বদলি এখন হয় প্রিতিদিনের সাবান (ডেইলি সোপ)। সিনেমা জগতে একজন পরিবর্তন নিয়ে এলেন, তিনি বললেন আমার সিনেমা নতুন কারন আমার সিনেমাতে আছে স্পেশাল ইফেক্ট, আমি অভিনয় করি টম ক্রুজের মত। আবার কেউ কেউ পড়ে আছেন পাহাড় নিয়ে, যেনো সবাই মিলে পাহাড় চূড়ায় উঠলে আমাদের শ্রমজীবী মানুষ মফিজ মিয়া আর আবুল মিয়াদের ছেলেমেয়েদের খাওয়া পড়া আর শিক্ষা দীক্ষার কোনো চিন্তা থাকবে না। আর বদলে যাও গ্রুপের তো পরিবর্তন সম্পর্কে ধারনা হচ্ছে পরিবর্তন মানে রাস্তায় যেখানে সেখানে ময়লা ফেলা যাবে না; কফ, থুথু ফেলা যাবে না; বাসে মহিলা সিটে বসা যাবে না, তাহলেই নাকি আমাদের সমাজটা বদলে যাবে। এই হচ্ছে পরিবর্তন সম্পর্কে আমাদের ধারনা। তবে পরিবর্তন যে দরকার তা পরিবর্তন সম্পর্কে এই ধরনের মানসিকতা দেখেই বুঝা যায়।




তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে পরিবর্তন বলতে আমরা কি বুঝি? পরিবর্তনটাই বা কেনো চাই আর কিভাবে চাই? পরিবর্তন ইতিবাচক বা নেতিবাচক দুই ধরনেরই হতে পারে। তবে পরিবর্তন বলতে সাধারনত ইতিবাচক পরিবর্তনকেই বুঝানো হয়। এখন সমাজে যদি পরিবর্তন আনতে হয় তাহলে সেটা হতে হবে এমন পরিবর্তন যা আমাদের সমাজটাকে ইতিবাচকভাবে পরিবর্তন করে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সমাজের প্রতিটি স্তরে চলা শোষনকে দূর করবে, জনগনের সাধারন চেতনাগত মানকে উন্নত করবে।
সহজ ভাষায় পরিবর্তন হতে হবে প্রগতির পথে।




এখন পরিবর্তন যে করবো, কিসের পরিবর্তন করবো? আর কিভাবেই বা সেটা পরিবর্তন করবো? কি পরিবর্তন করবো তা জানার জন্য প্রথমেই আমাদের বুঝতে হবে আমাদের সংকটটা কোথায়? বলিউডের অভিষেক ও ঐশ্বরিয়া বচ্চনের ছেলে হবে না মেয়ে হবে সেটা আমাদের সংকট, না কেনো স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও এখোনো আমাদের দেশের মানুষ না খেয়ে থাকে সেটা আমাদের সংকট, সেই পার্থক্যটা আমাদের আগে বুঝতে হবে। জাতি হিসেবে আমাদের চেতনাগত মানের ক্রমাগত নিম্নমুখিতার কারনে আজ আমরা আমাদের সংকট গুলোকে চিহ্নিত করতে ভুল করছি। এখোনো আমাদের দেশের হাজারো মেয়েকে
ভাত, কাপড় যোগানোর জন্য নিজের শরীর বিক্রী করতে হয়, প্রতি রাতে শত শত পরিবার গৃহহীন হয়ে যাচ্ছে, ক্ষুদার জ্বালায় ছিন্নমূল শিশুরা চুরি করতে বাধ্য হচ্ছে। গার্মেন্টস কর্মীরা মারা যাচ্ছে পোকামাকড়ের মত। একদিনে হাজার খানেক লাশ যেনো এখন কোনো ঘটনাই না। দুইদিন মিডিয়াতে মাতামাতি, তারপর সব ঠান্ডা। তরুনরা মেতে আছে শাহরুখ খান বা সুনিধি চৌহানের কনসার্ট নিয়ে। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা একসময় আমাদের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বকারী ভূমিকা রেখেছিলো, তারা আজ মেতে আছে বিশ্বকাপের ব্যাটে সাইন করার উন্মাদনায় কিংবা ঠিকাদারির টেন্ডারবাজীতে। আজকের সমাজে খুব সহজেই সন্তান তার পিতার কাছে আবদার করে আব্বু বিসিএস পরিক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, কিনতে টাকা লাগবে। পিতা তার পুত্রের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, বাবা চিন্তা করিস না টাকার ব্যবস্থা আমি করছি। এখন পিতা ও পুত্রের সম্পর্কটা এমনই। ঠিক যখন সাভারে একদিনে হাজার হাজার মানুষ ভবন চাপা পড়ে মারা গেলো আর আর হাজার দুয়েক মানুষ মৃত্যু যন্ত্রনায় আর্তনাদ করছিলো তখন আমাদের দেশের মিডিয়া কর্মিরা পুরস্কার বিতরনের নামে নর্দন কুর্দনে মহাব্যস্ত। কোন কোন পাহাড় জয়ী আবার লাশের মিছিলে গিয়ে ফটোশেষনে ব্যস্ত। এই হচ্ছে আমাদের সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্র। 




পাশাপাশি আমাদের সমাজটা হচ্ছে শ্রেনীবিভক্ত। সঙ্খ্যা গুরুর উপর সঙ্খ্যা লঘুর শোষনের উপরই আমদের অর্থনীতি টিকে আছে। আমাদের দেশে খুব সহজে বলা হয় এখানে শ্রম সস্তা, অর্থ্যাৎ সোজা বাংলায় বললে শ্রমিককে তার প্রাপ্য মজুরি না দিলেও চলে। প্রতিমিনিটে, প্রতিঘন্টায় শ্রমিকের শ্রমচুরির টাকায় তৈরী হয় দক্ষিন এশিয়ার সর্ববৃহৎ শপিং কমপ্লেক্স। এভাবে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে তৈরী হয়েছে একটি শ্রমদাসত্ব মূলক ব্যবস্থা। একশ্রেনীর মানুষ লুটের টাকায় পার্টিসেন্টার, গলফ ক্লাবে চিত্তবিনোদনে ব্যস্ত আরেক শ্রেনীর মানুষ বংশপরিক্রমায় দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে ক্রমাগত মানবেতর থেকে অতিমানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে।




এখন সমাজ পরিবর্তন করতে হলে এই দাসত্বমূলক ব্যবস্থাটাকেই ভেঙ্গে ফেলতে হবে। মানুষে মানুষে শ্রেনী শোষন সমূলে উপরে ফেলতে হবে। মানুষের নৈতিক স্তরকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে যাতে মানুষ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলে “এই শোষন মানি না, মানবো না”। এমন সমাজ দেখতে চাই যেখানে গার্মেন্টস শ্রমিকের বেতন ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শাহবাগ বা মতিঝিলে জড়ো হয়ে আন্দোলন করবে। চলচ্চিত্র তৈরী হবে “তাহাদের কথা” বা “গৃহযুদ্ধের” মত, যেখানে শোষনের বিরুদ্ধে মানুষের অদম্য লড়াইয়ের কথা বলা হবে। শাহরুখ খান, সুনিধি চৌহান বা আতিফ আসলামদের বদলে তরুনদের আদর্শ হবে চে’গুয়েভারা, মাস্টারদা সূর্যসেন বা ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতারা। তবেই হবে পরিবর্তন।





এই ঘুনেধরা সমাজে ভাঙ্গন অবশ্যম্ভাবী, প্রয়োজন শুধু সঠিক সময়ে, সঠিক জায়গায়, সঠিক ভাবে আঘাত। লড়াইয়ের অদম্য স্পৃহা নিয়ে তরুন সমাজ এই সমাজটাকে ভেঙ্গে একটি সুন্দর মানবিক সমাজ তৈরী করবে এই হোক আমদের পরিবর্তনের মূল মন্ত্র।

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৩

সামাজিক দায়িত্ব ও কম্বল বিতরন


আমাদের সমাজে সোস্যাল ওয়ার্ক নামে একটি কথা প্রচলিত আছে। যার মানে হচ্ছে সমাজের জন্য কিছু করা। এই সোস্যাল ওয়ার্কের আওতায় যেসব কাজ করা হয় তার মধ্যে হচ্ছে শীতকালে দরিদ্রদের মধ্যে কম্বল বিতরন করা, বন্যার্তদের মাঝে ত্রান বিতরন, সপ্তাহের বিশেষদিনে অসহায় মানুষদের মধ্যে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান, সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের বিনামূল্যে পাঠদান ইত্যাদি ইত্যাদি ...। আপাত দৃষ্টিতে এইসব কাজকে খুব মহৎ মনে হলেও এর মাঝে একধরনের আত্মতৃপ্তি ও আত্মপ্রবঞ্চনার ব্যাপার আছে। এর মধ্যে দিয়ে সমাজের সংকট গুলোকে মেনে নেয়ার একধরনের মানসিকতা প্রকাশ পায়।

ব্যাপারটি একটু ভালো করে লক্ষ্য করি। যখন গরিব মানুষদের মধ্যে কম্বল বা এইজাতীয় কোনো কিছু বিতরন করা হয় তখন আসলে কি চিন্তা কাজ করে? চিন্তাটি হচ্ছে যেহেতু সমাজের একশ্রেনীর মানুষ খুব দুঃখ কষ্টের মাঝে আছে তাই তাদের একটু সাহায্য করি, আমাদের সাহায্য ও সহযোগিতায় তাদের মুখে একটু হাসি ফুটুক। অনেকে ব্যাপারটা খোলাখুলি ভাবেই প্রকাশ করে “ওদের মুখে হাসি দেখাতেই আমার আনন্দ”। এই ধরনের সাহায্য সহযোগিতায় সবসময় দুটো পক্ষ থাকে। একজন দাতা আর একজন গ্রহীতা, দাতা সবসময় দান করে তার মহত্বের পরিচয় দিয়ে যাবেন আর গ্রহিতা সবসময় হাত পেতে দান গ্রহন করে আত্মগ্লানিতে ভুগবেন। এর ফলে দাতাদের মধ্যে একধরনের আত্মতৃপ্তি কাজ করে। আহা আমি কত মহৎ, আমি কত জনদরদি, আমি মানুষের জন্য ভাবি... ইত্যাদি। এইধরনের দান ও সাহায্য শেষ পর্যন্ত ঐ মানুষ গুলোর জীবনে কোনো পরিবর্তনই আনতে পারে না। উপরন্তু যেটা তাদের অধিকার সেটা দান হিসেবে পেয়ে তারা নিজেদের ধন্য মনে করে। সমাজে মানুষে মানুষে যে শ্রেনীবিভেদ , মানুষের প্রতি মানুষের যে শোষন সেটাকে দূর না করে এই ধরনের দান ও সাহায্য শেষ পর্যন্ত এই বৈষম্যমূলক সমাজের পক্ষেই কাজ করে।

এইধরনের কাজ যে শুধু নিরর্থক তাই না, এর একটা নেতিবাচক প্রভাবও তরুন সমাজের মধ্যে পরে। যে তরুনদের কাজ হচ্ছে নিজের মেধা, শিক্ষা ও পরিশ্রম দ্বারা সমাজের বৈষম্যগুলোকে দূর করে একটা সুন্দর সমাজ গড়ে তোলা সেই তরুনরা এই ধরনের নিরর্থক কাজ করে মনে করে সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ব শেষ। ফলশ্রুতিতে দেখা যায় সারারাত ধরে ত্রানের কম্বল বিতরন করে তরুনরা পরেরদিন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছে “ অসাধারন একটা দিন কাটালাম” , “আজ বুঝতে পারলাম এই মানুষগুলো নিয়তির কাছে কি অসহায়”... । এই ধরনের বিভিন্ন নাকি কান্না মূলক কথাবার্তা বলতে থাকে। সমাজের প্রতি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিস্কার না থাকার কারনে সারারাত ধরে কম্বল বিতরন করা ছেলেটিই তার বাস্তব জীবনে বিভিন্ন শোষন মূলক কর্মকান্ডে জড়িত থাকে। উদাহরন স্বরূপ ধন্যাঢ্য পিতার ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া ছেলে বা মেয়েটি সারাদিন ফুল বিক্রি করে সেই টাকায় ছিন্নমূল শিশুদের একদিনের খাবার যোগালেও (এই বিশেষ দিনে ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র ছাত্রীরা বিশেষ ধরনের টি শার্ট পরে এবং পরদিন পত্রিকায় ওদের ফুল বিক্রির ছবি ছাপা হয়) সে বুঝতে পারে না তার বাবার ফ‍্যাক্টরিতেই হাজার হাজার শ্রমিকের শ্রম চুরি করা হচ্ছে প্রতিদিন, সেই শ্রমচুরির টাকাতেই সে মার্সিডিজ বেঞ্জ হাঁকায়। অনেকে আবার এই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও তার শ্রেনীগত অবস্থানের কারনে এইধরনের শোষনের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় না, কম্বল বিতরনের মাঝেই সে তার কর্তব্য সারে।


এতো গেলো উচ্চবিত্ত পরিবারের সৌখিন তরুনদের কথা, মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক তরুনও এই ধরনের ত্রান বিতরন জাতীয় কাজে নিজেদের নিয়োজিত করে। এরা ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন কর্পোরেট কোম্পানীর দ্বারা। এইসব কর্পোরেট গোষ্ঠীরা সমাজ সেবার নামে সমাজের মধ্যে নিজেদের গ্রহনযোগ্যতা বাড়িয়ে তোলে। গরীবের রক্তচুষে জমানো টাকায় গরীবকে সান্তনা সূচক ত্রান বিতরন করে, অনেকটা গরু মেরে জুতা দানের মত। এর একটা সুন্দর নামও আছে, ওদের ভাষায় সিএসআর অর্থাৎ কর্পোরেট সোস্যাল রেস্পন্সিবিলিটি। দেশের স্বার্থবিরোধী এই সব কোম্পানী ওদের অপকর্ম ও শোষনকে নির্ভীগ্নে চালিয়ে যাওয়ার স্বার্থে দেশের মানুষকে চোখে ধুলো দিতে এইসব কাজ করে থাকে। আর এইসব কর্মকান্ডকে সাধারন মানুষের কাছে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করে কর্পোরেট গোষ্ঠীর পোষা মিডিয়া। মানব সেবার পাশাপাশি এরা তরুনদের ভেতর একধরনের ভোগবাদী মানসিকতা তৈরী করে। সামাজিক দায়িত্ব ভুলে তরুনরা পরিনত হয় সৌখিন সমাজ কর্মীতে। ফলে এই ধরনের তরুনরা ত্রান বিতরনে যতটা আগ্রহী ঠিক ততোটাই অনাগ্রহী সমাজ পরিবর্তনের কাজে আত্মনিয়োগ করতে।


এখন মনে প্রশ্ন আসতে পারে মানুষ যখন বিপদে পরে তখন কি আমরা হাতপা গুটিয়ে বসে থাকবো? না তা অবশ্যই নয়। মানুষ হিসেবে সব সময়ই আমাদের মানুষের পাশে দাড়াঁতে হবে। কিন্তু তা যেনো শুধু কম্বল বিতরনের মাঝে সীমাবদ্ধ না থাকে। আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে এই ধরনের সাহায্য সব সময়ই একটা অস্থায়ী টোটকা ব্যবস্থা। পুরো সমাজ জুড়ে চলা শোষন দূর করতে না পারলে এই ধরনের সংকট সব সময়ই থেকে যাবে। তাই তরুনদের বুঝতে হবে শুধু কম্বল বা বিনামূল্যে স্যালাইন বিতরন করলেই আমাদের দায়িত্ব শেষ না। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে এই সমাজের প্রতিটি স্তরে চলা অমানবিক শোষন ও অবিচার দূর করে সমধিকার ভিত্তিক একটি মানবিক সমাজ গঠন করা। সাথে সাথে এটাও মনে রাখতে হবে কর্পোরেট গোষ্ঠী যতই সোস্যাল রেস্পন্সিবিলিটির কথা বলুক না কেনো, ওদের মূল উদ্দ্যেশ্য হচ্ছে মুনাফা করা। আর ওদের মুনাফার জন্য একমাত্র শর্ত হচ্ছে এই শোষন মূলক ব্যবস্থাটাকে জারি রাখা। তাই এই শ্রেনী কর্পোরেট শোষক ও তাদের তাবেদার মিডিয়ার মুখোশ খুলে দিতে না পারলে ও তাদের প্রতিহত করতে না পারলে এই শোষন কোনো দিনই দূর হবে না। উদাহরন স্বরূপ কিছুদিন আগে এশিয়া এনার্জির কর্মকর্তা গ্যারী লাই ফুলবাড়িয়াতে ত্রান বিতরন করতে গেলে সাধারন মানুষের প্রতিরোধের মুখে পালিয়ে বাঁচে। কারন মানুষ বুঝতে পেরেছিলো ত্রানের আড়ালে ওদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ফুলবাড়িয়ার কয়লা খনি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন। এভাবে আমাদের সব সুবিধাবাদী গোষ্ঠিকে প্রতিহত করতে হবে। যাতে আর কেও  কম্বলের বিনিময়ে আমাদের মূল্যবান সম্পদ হাতিয়ে নিতে না পারে।

সবশেষে একটা কথাই বলতে চাই, সমাজ পরিবর্তন করে শোষনহীন সমাজ গড়তে হলে সবার প্রথমে নিজের শ্রেনী অবস্থান ত্যাগ করে , সকল প্রকার ভাবগত ও বস্তুগত সম্পদ চর্চা বাদ দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। তবেই সম্ভব হবে একটি সুন্দর, মানবিক ও আধুনিক সমাজ গড়া।