পোস্টকার্ড ব্লগের “ লোকায়ত কথোপকথন ” পাতাটি সবার জন্য উন্মুক্ত । লিখতে চাইলে আমাদের মেইল করে জানান । সাগ্রাহে আমরা আমান্ত্রন জানাবো। আমাদের মেইল ঠিকানা postcarduv@gmail.com। বাছাইকৃত লেখাটি পোস্ট কার্ড সংখ্যায় প্রকাশ করা হবে।

শুক্রবার, ৩১ মে, ২০১৩

পরিবর্তনঃ কেন চাই? কিভাবে চাই


চারপাশে শুধু একটাই কথা পরিবর্তন চাই পরিবর্তন । সবাই পরিবর্তন চায়। অলিতে, গলিতে,  পাড়া, মহল্লায়, চায়ের আড্ডায়, সোশ্যাল মিডিয়া, ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু হচ্ছে পরিবর্তন। কেউ কেউতো আবার পরিবর্তন নিয়ে “বদলে দাও, বদলে যাও” নামে কর্পোরেট প্রজেক্ট চালু করে ফেলেছে। সেদিন একজন বলছিলেন ‘ভাই দেশটার অবস্থা ভালো না পরিবর্তন দরকার’, ওনার পরিবর্তন দরকার কারন দেশের এই অস্থিতিশীল অবস্থায় ওনার গাড়ি বিক্রির ব্যবসাটা ভালো চলছে না। এখন কেউ গাড়ি কেনার ঝুকি নিতে চায় না। কখন কে গাড়িতে আগুন দিয়ে দেয় তাই। মিডিয়াতেও এখন পরিবর্তনের ঢেউ চলছে। ভারতীয় সিরিয়ালের সাথে টেক্কা দিতে একজন সিনিয়র অভিনেত্রী ফর্মুলা নিয়ে এলেন, এখন থেকে ওদের সাথে প্রতিযোগিতা করতে হলে আমাদের ওদের মতোই মসলাদার সিরিয়াল বানাতে হবে। তো শুরু হয়ে গেলো নাট্য জগতে পরিবর্তন। নাটকের বদলি এখন হয় প্রিতিদিনের সাবান (ডেইলি সোপ)। সিনেমা জগতে একজন পরিবর্তন নিয়ে এলেন, তিনি বললেন আমার সিনেমা নতুন কারন আমার সিনেমাতে আছে স্পেশাল ইফেক্ট, আমি অভিনয় করি টম ক্রুজের মত। আবার কেউ কেউ পড়ে আছেন পাহাড় নিয়ে, যেনো সবাই মিলে পাহাড় চূড়ায় উঠলে আমাদের শ্রমজীবী মানুষ মফিজ মিয়া আর আবুল মিয়াদের ছেলেমেয়েদের খাওয়া পড়া আর শিক্ষা দীক্ষার কোনো চিন্তা থাকবে না। আর বদলে যাও গ্রুপের তো পরিবর্তন সম্পর্কে ধারনা হচ্ছে পরিবর্তন মানে রাস্তায় যেখানে সেখানে ময়লা ফেলা যাবে না; কফ, থুথু ফেলা যাবে না; বাসে মহিলা সিটে বসা যাবে না, তাহলেই নাকি আমাদের সমাজটা বদলে যাবে। এই হচ্ছে পরিবর্তন সম্পর্কে আমাদের ধারনা। তবে পরিবর্তন যে দরকার তা পরিবর্তন সম্পর্কে এই ধরনের মানসিকতা দেখেই বুঝা যায়।




তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে পরিবর্তন বলতে আমরা কি বুঝি? পরিবর্তনটাই বা কেনো চাই আর কিভাবে চাই? পরিবর্তন ইতিবাচক বা নেতিবাচক দুই ধরনেরই হতে পারে। তবে পরিবর্তন বলতে সাধারনত ইতিবাচক পরিবর্তনকেই বুঝানো হয়। এখন সমাজে যদি পরিবর্তন আনতে হয় তাহলে সেটা হতে হবে এমন পরিবর্তন যা আমাদের সমাজটাকে ইতিবাচকভাবে পরিবর্তন করে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। সমাজের প্রতিটি স্তরে চলা শোষনকে দূর করবে, জনগনের সাধারন চেতনাগত মানকে উন্নত করবে।
সহজ ভাষায় পরিবর্তন হতে হবে প্রগতির পথে।




এখন পরিবর্তন যে করবো, কিসের পরিবর্তন করবো? আর কিভাবেই বা সেটা পরিবর্তন করবো? কি পরিবর্তন করবো তা জানার জন্য প্রথমেই আমাদের বুঝতে হবে আমাদের সংকটটা কোথায়? বলিউডের অভিষেক ও ঐশ্বরিয়া বচ্চনের ছেলে হবে না মেয়ে হবে সেটা আমাদের সংকট, না কেনো স্বাধীনতার ৪০ বছর পরও এখোনো আমাদের দেশের মানুষ না খেয়ে থাকে সেটা আমাদের সংকট, সেই পার্থক্যটা আমাদের আগে বুঝতে হবে। জাতি হিসেবে আমাদের চেতনাগত মানের ক্রমাগত নিম্নমুখিতার কারনে আজ আমরা আমাদের সংকট গুলোকে চিহ্নিত করতে ভুল করছি। এখোনো আমাদের দেশের হাজারো মেয়েকে
ভাত, কাপড় যোগানোর জন্য নিজের শরীর বিক্রী করতে হয়, প্রতি রাতে শত শত পরিবার গৃহহীন হয়ে যাচ্ছে, ক্ষুদার জ্বালায় ছিন্নমূল শিশুরা চুরি করতে বাধ্য হচ্ছে। গার্মেন্টস কর্মীরা মারা যাচ্ছে পোকামাকড়ের মত। একদিনে হাজার খানেক লাশ যেনো এখন কোনো ঘটনাই না। দুইদিন মিডিয়াতে মাতামাতি, তারপর সব ঠান্ডা। তরুনরা মেতে আছে শাহরুখ খান বা সুনিধি চৌহানের কনসার্ট নিয়ে। যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা একসময় আমাদের ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বকারী ভূমিকা রেখেছিলো, তারা আজ মেতে আছে বিশ্বকাপের ব্যাটে সাইন করার উন্মাদনায় কিংবা ঠিকাদারির টেন্ডারবাজীতে। আজকের সমাজে খুব সহজেই সন্তান তার পিতার কাছে আবদার করে আব্বু বিসিএস পরিক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, কিনতে টাকা লাগবে। পিতা তার পুত্রের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, বাবা চিন্তা করিস না টাকার ব্যবস্থা আমি করছি। এখন পিতা ও পুত্রের সম্পর্কটা এমনই। ঠিক যখন সাভারে একদিনে হাজার হাজার মানুষ ভবন চাপা পড়ে মারা গেলো আর আর হাজার দুয়েক মানুষ মৃত্যু যন্ত্রনায় আর্তনাদ করছিলো তখন আমাদের দেশের মিডিয়া কর্মিরা পুরস্কার বিতরনের নামে নর্দন কুর্দনে মহাব্যস্ত। কোন কোন পাহাড় জয়ী আবার লাশের মিছিলে গিয়ে ফটোশেষনে ব্যস্ত। এই হচ্ছে আমাদের সমাজের নৈতিক অবক্ষয়ের চিত্র। 




পাশাপাশি আমাদের সমাজটা হচ্ছে শ্রেনীবিভক্ত। সঙ্খ্যা গুরুর উপর সঙ্খ্যা লঘুর শোষনের উপরই আমদের অর্থনীতি টিকে আছে। আমাদের দেশে খুব সহজে বলা হয় এখানে শ্রম সস্তা, অর্থ্যাৎ সোজা বাংলায় বললে শ্রমিককে তার প্রাপ্য মজুরি না দিলেও চলে। প্রতিমিনিটে, প্রতিঘন্টায় শ্রমিকের শ্রমচুরির টাকায় তৈরী হয় দক্ষিন এশিয়ার সর্ববৃহৎ শপিং কমপ্লেক্স। এভাবে দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে তৈরী হয়েছে একটি শ্রমদাসত্ব মূলক ব্যবস্থা। একশ্রেনীর মানুষ লুটের টাকায় পার্টিসেন্টার, গলফ ক্লাবে চিত্তবিনোদনে ব্যস্ত আরেক শ্রেনীর মানুষ বংশপরিক্রমায় দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে ক্রমাগত মানবেতর থেকে অতিমানবেতর জীবনযাপনে বাধ্য হচ্ছে।




এখন সমাজ পরিবর্তন করতে হলে এই দাসত্বমূলক ব্যবস্থাটাকেই ভেঙ্গে ফেলতে হবে। মানুষে মানুষে শ্রেনী শোষন সমূলে উপরে ফেলতে হবে। মানুষের নৈতিক স্তরকে এমন জায়গায় নিয়ে যেতে হবে যাতে মানুষ গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলে “এই শোষন মানি না, মানবো না”। এমন সমাজ দেখতে চাই যেখানে গার্মেন্টস শ্রমিকের বেতন ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা শাহবাগ বা মতিঝিলে জড়ো হয়ে আন্দোলন করবে। চলচ্চিত্র তৈরী হবে “তাহাদের কথা” বা “গৃহযুদ্ধের” মত, যেখানে শোষনের বিরুদ্ধে মানুষের অদম্য লড়াইয়ের কথা বলা হবে। শাহরুখ খান, সুনিধি চৌহান বা আতিফ আসলামদের বদলে তরুনদের আদর্শ হবে চে’গুয়েভারা, মাস্টারদা সূর্যসেন বা ক্ষুদিরাম, প্রীতিলতারা। তবেই হবে পরিবর্তন।





এই ঘুনেধরা সমাজে ভাঙ্গন অবশ্যম্ভাবী, প্রয়োজন শুধু সঠিক সময়ে, সঠিক জায়গায়, সঠিক ভাবে আঘাত। লড়াইয়ের অদম্য স্পৃহা নিয়ে তরুন সমাজ এই সমাজটাকে ভেঙ্গে একটি সুন্দর মানবিক সমাজ তৈরী করবে এই হোক আমদের পরিবর্তনের মূল মন্ত্র।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন