পোস্টকার্ড ব্লগের “ লোকায়ত কথোপকথন ” পাতাটি সবার জন্য উন্মুক্ত । লিখতে চাইলে আমাদের মেইল করে জানান । সাগ্রাহে আমরা আমান্ত্রন জানাবো। আমাদের মেইল ঠিকানা postcarduv@gmail.com। বাছাইকৃত লেখাটি পোস্ট কার্ড সংখ্যায় প্রকাশ করা হবে।

রবিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৪

অদৃশ্য বিষের ছোবল

“মা, ফুলে কি ফরমালিন আছে?”, বলছিল ছয় বছরের স্কুল পড়ুয়া ফারিয়া, বাড়ির ছাদে ফুল বাগানে মায়ের সাথে হাঁটতে গিয়েমা বলল, “কেন মা হঠাৎ এই প্রশ্ন?” “না, মা তোমরাই তো বল এখন সবকিছুতেই ফরমালিন...” ছোট শিশুও আজ ফরমালিন নামক বিষের কথা জেনে গেছে, যা কয়েক বছর আগেও ছিল আমাদের জানার বাইরে।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ফলমূল, শাক-সবজি, মাছ-মাংস, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য থেকে শুরু করে চাল, ডাল, হলুদের গুঁড়া, লবণ, ফাস্টফুড, কোমল পানীয় সবকিছুতেই ফরমালিন ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের ছোবলে বিষময়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও) এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় গড়ে তোলা দেশের সর্বাধুনিক খাদ্য নিরাপত্তা গবেষণাগারে পরীক্ষায় দেশের ৪০ শতাংশ খাদ্যেই ভয়ংকর সব ভেজাল ও বিষাক্ত রাসায়নিকের প্রমান মিলেছে। যার মধ্যে নিষিদ্ধ ডিডিটি থেকে শুরু করে রয়েছে বেনজয়িক এসিড, অ্যালড্রিন, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক, সিসা, ফরমালিন ইত্যাদির মত ভয়ংকর উপাদান। তাহলে এসব খাদ্য গ্রহনের পূর্বে আমরা কি একবারও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছি না, কি খাচ্ছি? বা আমাদের পরিবার বা সন্তানের মুখে কি ঢেলে দিচ্ছি??!! আজ শ্বাসকষ্ট, পলিপাস, হাতে-পায়ে ব্যাথা, গ্যাসট্রো-ইন্টেস্টাইন্যাল ডিজিজ, কিডনি ডিজিজ, ফুসফুস ক্যান্সার, লিউকেমিয়া, ইউরিনারীট্রাক্ট জনিত সমস্যাগুলো কেন বাড়ছে? পরিবারের সদস্যরা প্রায়ই অসুস্থ থাকছে আর খরচ হচ্ছে হাজার হাজার টাকা।

তাহলে কি খাবো? প্রশ্ন সবারই...। চলুন বৃষ্টির পানি বা বাতাস খেয়ে বাঁচা যাক...! কিন্তু সেটাও কি নিঃসংশয়ে নিতে পারব?? সৃষ্টিকর্তার দান এই সম্পদগুলোও যে আমাদের মনুষ্য জগতের বিষাক্ত ছোবল থেকে রক্ষা পায় নি। পরিবেশ দূষণ, বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, খাদ্য বিষক্রিয়ার ফলে এসিড বৃষ্টি হচ্ছে, বাতাসে মিশে আছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, সালফার-ডাই-অক্সাইড, লেড, সীসা ইত্যাদি। আমরা ক্রেতাগন বাজারে বাহারি রঙের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ক্রয় করছি কার্বাইড, ইথিলিনযুক্ত পাকা আম, কাঁঠাল, তরমুজ, পেঁপে, লিচু, বরই, দাগ-মুক্ত ফল, শাক-সবজি ইত্যাদি। ভেজাল মিশ্রণকারীদের আমরাই কি উৎসাহিত করছি না? আজ নিরক্ষর বা স্বল্প শিক্ষিত কৃষকের ফসলের ন্যায্য মূল্য না দিয়ে তাদের অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে তুলে দিচ্ছি আমরা শিক্ষিত সমাজ ক্ষতিকর কীটনাশক, রাসায়নিক পদার্থ। বিশেষজ্ঞরা জানান, কৃষি বলতে কেবল ফসলই নয়, মৎস্যসম্পদও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মৎস্য সম্পদ অধিদপ্তরের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মাছে ব্যবহৃত কীটনাশকের মধ্যে ৬০ শতাংশ চরম বিষাক্ত, ৩০ শতাংশ একটু কম আর ১০ শতাংশ বিষাক্ত নয়। এছাড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রতিবছর বৈধ ভাবে প্রায় ২৭ হাজার টন কীটনাশক ব্যবহার হচ্ছে। এছাড়া বিশ্বব্যাংক ২০০৭ সালে এ প্রতিবেদনে বলেছিল বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশেরও বেশি কৃষক ফসলে প্রয়োজনের বেশি কীটনাশক ব্যবহার করে। তাহলে এর সমাধান কি হতে পারে? জনগণ ও সরকারকেই এর সমাধান বের করতে হবে। সরকার যদি কৃষকের উৎপাদিত পণ্য ভোক্তার নিকট সরাসরি উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সঠিক সংরক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে পৌঁছে দিত, উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত মধ্যসত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ন্যকে অবরোধ করতে পারত তাহলে আমাদের কৃষক কি নিজেদের সোনার ফসলকে বিষের ফসলে রূপান্তরিত করতে পারত?

বর্তমানে সমাজে সম্পদের অপ্রতুলতা, অসৎ ব্যক্তিদের মুনাফাধর্মী ব্যবসার কারণে আমরাও যেন আমাদের ন্যায়বোধ হারিয়ে কোন মরীচিকার পিছনে ছুটছি। তবুও আজও ভালো, সৎ, ন্যায়বান মানুষ আছে সমাজে, হয়তো বা তাদের সংখ্যা খুব কম। সুশীল সমাজ ও সচেতন নাগরিকগণ সবাইকেই সম্মিলিতভাবে এগিয়ে এসে সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।

এ তো গেল আপনার জনসাধারণের কথা, এবার সরকারের দিকে নজর দিই। রাষ্ট্র ও সরকার কি আমাদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারছে, যেখানে খাদ্য আমাদের মৌলিক চাহিদা। গ্রাম ও শহর দুটোই এ ভেজালে আক্রান্ত যদিও গ্রামে তুলনামূলকভাবে কম। সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার উপর কি সঠিক তদারকি বর্তায় না? যদিও তাদের মতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও লোকবলের অভাব। আবার এই ভেজাল বিরোধী অভিযানে তারাই কতিপয় স্বার্থান্বেষী লোকের অর্থলোভে ভেজাল মিশ্রিত হয়ে যাচ্ছে। ভেজাল বন্ধে ‘খাদ্য নিরাপত্তা আইন ২০১৩’ প্রণীত হলেও তা এখনও বিধি হয়নি। তাই সরকার যদি সরাসরি তদারকি ও কঠিন আইন কার্যকর করার মাধ্যমে ও রাজনৈতিক সহিংসতা প্রত্যাহার করে রাষ্ট্রের গুরুদায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করে তবেই হয়তো সবার সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সম্ভবপর হবে।

ফারজানা লিমা
কৃষি অনুষদ, ২য় বর্ষ
শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
শেরে বাংলা নগর, ঢাকা ।

৩টি মন্তব্য:

  1. এই রাষ্ট্র হচ্ছে শোষক ও লুটেরাদের রাষ্ট্র। তাই যতদিন রাষ্ট্র চরিত্র না বদলাবে ততদিন এই রাষ্ট্রে এই ধরনের সমস্যা চলতেই থাকবে। সমাধান একটাই এই রাষ্ট্রব্যবস্থা উচ্ছেদ করে জনগনের রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েম করা।

    উত্তরমুছুন
  2. ভালো লেগেছে লেখাতে সচেতন হবার আহবানের অংশটা। আমাদের দৈনন্দিনের যাপিত জীবনের সাথে সম্পর্কিত এরকম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে ভবিষ্যতে আরও আলোকপাত আশা করছি।

    উত্তরমুছুন

  3. শুধু খাদ্যে ফরমালিন কেন,আমাদের চারপাশের আরও অনেক সমস্যা নিয়েই বলা যেতে পারে। লেখিকার পরিচয়ে দেখছি উনি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী। কৃষি ও কৃষককে ঘিরে দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে যে সমস্যাগুলো রয়েছে তার উপর লেখিকার নতুন লেখা আশা করছি।

    উত্তরমুছুন