পোস্টকার্ড ব্লগের “ লোকায়ত কথোপকথন ” পাতাটি সবার জন্য উন্মুক্ত । লিখতে চাইলে আমাদের মেইল করে জানান । সাগ্রাহে আমরা আমান্ত্রন জানাবো। আমাদের মেইল ঠিকানা postcarduv@gmail.com। বাছাইকৃত লেখাটি পোস্ট কার্ড সংখ্যায় প্রকাশ করা হবে।

বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল, ২০১৩

সামাজিক দায়িত্ব ও কম্বল বিতরন


আমাদের সমাজে সোস্যাল ওয়ার্ক নামে একটি কথা প্রচলিত আছে। যার মানে হচ্ছে সমাজের জন্য কিছু করা। এই সোস্যাল ওয়ার্কের আওতায় যেসব কাজ করা হয় তার মধ্যে হচ্ছে শীতকালে দরিদ্রদের মধ্যে কম্বল বিতরন করা, বন্যার্তদের মাঝে ত্রান বিতরন, সপ্তাহের বিশেষদিনে অসহায় মানুষদের মধ্যে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান, সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের বিনামূল্যে পাঠদান ইত্যাদি ইত্যাদি ...। আপাত দৃষ্টিতে এইসব কাজকে খুব মহৎ মনে হলেও এর মাঝে একধরনের আত্মতৃপ্তি ও আত্মপ্রবঞ্চনার ব্যাপার আছে। এর মধ্যে দিয়ে সমাজের সংকট গুলোকে মেনে নেয়ার একধরনের মানসিকতা প্রকাশ পায়।

ব্যাপারটি একটু ভালো করে লক্ষ্য করি। যখন গরিব মানুষদের মধ্যে কম্বল বা এইজাতীয় কোনো কিছু বিতরন করা হয় তখন আসলে কি চিন্তা কাজ করে? চিন্তাটি হচ্ছে যেহেতু সমাজের একশ্রেনীর মানুষ খুব দুঃখ কষ্টের মাঝে আছে তাই তাদের একটু সাহায্য করি, আমাদের সাহায্য ও সহযোগিতায় তাদের মুখে একটু হাসি ফুটুক। অনেকে ব্যাপারটা খোলাখুলি ভাবেই প্রকাশ করে “ওদের মুখে হাসি দেখাতেই আমার আনন্দ”। এই ধরনের সাহায্য সহযোগিতায় সবসময় দুটো পক্ষ থাকে। একজন দাতা আর একজন গ্রহীতা, দাতা সবসময় দান করে তার মহত্বের পরিচয় দিয়ে যাবেন আর গ্রহিতা সবসময় হাত পেতে দান গ্রহন করে আত্মগ্লানিতে ভুগবেন। এর ফলে দাতাদের মধ্যে একধরনের আত্মতৃপ্তি কাজ করে। আহা আমি কত মহৎ, আমি কত জনদরদি, আমি মানুষের জন্য ভাবি... ইত্যাদি। এইধরনের দান ও সাহায্য শেষ পর্যন্ত ঐ মানুষ গুলোর জীবনে কোনো পরিবর্তনই আনতে পারে না। উপরন্তু যেটা তাদের অধিকার সেটা দান হিসেবে পেয়ে তারা নিজেদের ধন্য মনে করে। সমাজে মানুষে মানুষে যে শ্রেনীবিভেদ , মানুষের প্রতি মানুষের যে শোষন সেটাকে দূর না করে এই ধরনের দান ও সাহায্য শেষ পর্যন্ত এই বৈষম্যমূলক সমাজের পক্ষেই কাজ করে।

এইধরনের কাজ যে শুধু নিরর্থক তাই না, এর একটা নেতিবাচক প্রভাবও তরুন সমাজের মধ্যে পরে। যে তরুনদের কাজ হচ্ছে নিজের মেধা, শিক্ষা ও পরিশ্রম দ্বারা সমাজের বৈষম্যগুলোকে দূর করে একটা সুন্দর সমাজ গড়ে তোলা সেই তরুনরা এই ধরনের নিরর্থক কাজ করে মনে করে সমাজের প্রতি তাদের দায়িত্ব শেষ। ফলশ্রুতিতে দেখা যায় সারারাত ধরে ত্রানের কম্বল বিতরন করে তরুনরা পরেরদিন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছে “ অসাধারন একটা দিন কাটালাম” , “আজ বুঝতে পারলাম এই মানুষগুলো নিয়তির কাছে কি অসহায়”... । এই ধরনের বিভিন্ন নাকি কান্না মূলক কথাবার্তা বলতে থাকে। সমাজের প্রতি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিস্কার না থাকার কারনে সারারাত ধরে কম্বল বিতরন করা ছেলেটিই তার বাস্তব জীবনে বিভিন্ন শোষন মূলক কর্মকান্ডে জড়িত থাকে। উদাহরন স্বরূপ ধন্যাঢ্য পিতার ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া ছেলে বা মেয়েটি সারাদিন ফুল বিক্রি করে সেই টাকায় ছিন্নমূল শিশুদের একদিনের খাবার যোগালেও (এই বিশেষ দিনে ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র ছাত্রীরা বিশেষ ধরনের টি শার্ট পরে এবং পরদিন পত্রিকায় ওদের ফুল বিক্রির ছবি ছাপা হয়) সে বুঝতে পারে না তার বাবার ফ‍্যাক্টরিতেই হাজার হাজার শ্রমিকের শ্রম চুরি করা হচ্ছে প্রতিদিন, সেই শ্রমচুরির টাকাতেই সে মার্সিডিজ বেঞ্জ হাঁকায়। অনেকে আবার এই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও তার শ্রেনীগত অবস্থানের কারনে এইধরনের শোষনের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় না, কম্বল বিতরনের মাঝেই সে তার কর্তব্য সারে।


এতো গেলো উচ্চবিত্ত পরিবারের সৌখিন তরুনদের কথা, মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক তরুনও এই ধরনের ত্রান বিতরন জাতীয় কাজে নিজেদের নিয়োজিত করে। এরা ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন কর্পোরেট কোম্পানীর দ্বারা। এইসব কর্পোরেট গোষ্ঠীরা সমাজ সেবার নামে সমাজের মধ্যে নিজেদের গ্রহনযোগ্যতা বাড়িয়ে তোলে। গরীবের রক্তচুষে জমানো টাকায় গরীবকে সান্তনা সূচক ত্রান বিতরন করে, অনেকটা গরু মেরে জুতা দানের মত। এর একটা সুন্দর নামও আছে, ওদের ভাষায় সিএসআর অর্থাৎ কর্পোরেট সোস্যাল রেস্পন্সিবিলিটি। দেশের স্বার্থবিরোধী এই সব কোম্পানী ওদের অপকর্ম ও শোষনকে নির্ভীগ্নে চালিয়ে যাওয়ার স্বার্থে দেশের মানুষকে চোখে ধুলো দিতে এইসব কাজ করে থাকে। আর এইসব কর্মকান্ডকে সাধারন মানুষের কাছে সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করে কর্পোরেট গোষ্ঠীর পোষা মিডিয়া। মানব সেবার পাশাপাশি এরা তরুনদের ভেতর একধরনের ভোগবাদী মানসিকতা তৈরী করে। সামাজিক দায়িত্ব ভুলে তরুনরা পরিনত হয় সৌখিন সমাজ কর্মীতে। ফলে এই ধরনের তরুনরা ত্রান বিতরনে যতটা আগ্রহী ঠিক ততোটাই অনাগ্রহী সমাজ পরিবর্তনের কাজে আত্মনিয়োগ করতে।


এখন মনে প্রশ্ন আসতে পারে মানুষ যখন বিপদে পরে তখন কি আমরা হাতপা গুটিয়ে বসে থাকবো? না তা অবশ্যই নয়। মানুষ হিসেবে সব সময়ই আমাদের মানুষের পাশে দাড়াঁতে হবে। কিন্তু তা যেনো শুধু কম্বল বিতরনের মাঝে সীমাবদ্ধ না থাকে। আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে এই ধরনের সাহায্য সব সময়ই একটা অস্থায়ী টোটকা ব্যবস্থা। পুরো সমাজ জুড়ে চলা শোষন দূর করতে না পারলে এই ধরনের সংকট সব সময়ই থেকে যাবে। তাই তরুনদের বুঝতে হবে শুধু কম্বল বা বিনামূল্যে স্যালাইন বিতরন করলেই আমাদের দায়িত্ব শেষ না। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে এই সমাজের প্রতিটি স্তরে চলা অমানবিক শোষন ও অবিচার দূর করে সমধিকার ভিত্তিক একটি মানবিক সমাজ গঠন করা। সাথে সাথে এটাও মনে রাখতে হবে কর্পোরেট গোষ্ঠী যতই সোস্যাল রেস্পন্সিবিলিটির কথা বলুক না কেনো, ওদের মূল উদ্দ্যেশ্য হচ্ছে মুনাফা করা। আর ওদের মুনাফার জন্য একমাত্র শর্ত হচ্ছে এই শোষন মূলক ব্যবস্থাটাকে জারি রাখা। তাই এই শ্রেনী কর্পোরেট শোষক ও তাদের তাবেদার মিডিয়ার মুখোশ খুলে দিতে না পারলে ও তাদের প্রতিহত করতে না পারলে এই শোষন কোনো দিনই দূর হবে না। উদাহরন স্বরূপ কিছুদিন আগে এশিয়া এনার্জির কর্মকর্তা গ্যারী লাই ফুলবাড়িয়াতে ত্রান বিতরন করতে গেলে সাধারন মানুষের প্রতিরোধের মুখে পালিয়ে বাঁচে। কারন মানুষ বুঝতে পেরেছিলো ত্রানের আড়ালে ওদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ফুলবাড়িয়ার কয়লা খনি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন। এভাবে আমাদের সব সুবিধাবাদী গোষ্ঠিকে প্রতিহত করতে হবে। যাতে আর কেও  কম্বলের বিনিময়ে আমাদের মূল্যবান সম্পদ হাতিয়ে নিতে না পারে।

সবশেষে একটা কথাই বলতে চাই, সমাজ পরিবর্তন করে শোষনহীন সমাজ গড়তে হলে সবার প্রথমে নিজের শ্রেনী অবস্থান ত্যাগ করে , সকল প্রকার ভাবগত ও বস্তুগত সম্পদ চর্চা বাদ দিয়ে সমাজ পরিবর্তনের কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। তবেই সম্ভব হবে একটি সুন্দর, মানবিক ও আধুনিক সমাজ গড়া।



শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৩

আধুনিক সমাজের দাসব্যবস্থাঃ বুয়া ও গৃহকর্মী


“বুয়া শ্রেনী ও গৃহভৃত্য দের walk way তে হাটা নিষেধ”। এই লেখাটি ঢাকা শহরের একটি অভিজাত এলাকায় অবস্থিত একটি পার্কের বাইরে সাইন বোর্ডে লেখা আছে। এই পার্কটি হচ্ছে সেই অভিজাত এলাকার অধিবাসী দের বিকেলে বা সকালে হাটাহাটির জায়গা। আর বুয়া শ্রেনী ও গৃহভৃত্যরা হচ্ছে তাদের বাসায় যে সব গৃহ কর্মী কাজ করে সেসব ব্যক্তি। কি প্রচন্ড শ্রেনী বিদ্বেষ প্রকাশিত হয়েছে এই লেখাটির মধ্যে। বুয়াদের হাত ধরেই অভিজাতদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এখানে খেলতে আসে, তারপরও বুয়ারা এখানে হাটতে পারবে না। এর পেছনে কি কোনো যুক্তি সঙ্গত কারন আছে? কারন আসলে একটাই সেটা হচ্ছে শ্রেনী বিভেদ। অভিজাত শ্রেনী বুয়া শ্রেনীদের তাদের সমঅধিকার ভুক্ত মানুষ মনে করে না। ক্ষেত্রবিশেষে ওদের মানুষই মনে করা হয় না। আমরা যতই একুশ শতকের অহংকার করিনা কেনো এখোনো এই সমাজ একটি শোষন মূলক সমাজই রয়ে গেছে। দাস প্রথা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে মনে হলেও তা আসলে বিলুপ্ত হয়নি। শুধু তার আবরনটা বদলেছে। সেটা এখন আরো অনেক বেশি পরিশিলিত আর সুশীল রুপ ধারন করেছে। দাস প্রথার বিভিন্ন রুপের মধ্যে একটা হচ্ছে এই গৃহভৃত্য বা বাসার কাজের বুয়া।

আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে কাজের বুয়াদের দাস বলাটা বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। কারন ওরাতো আর কৃতদাসদের মত বিক্রী হয়ে যায় নি বা ওদের তো আর চাইলেও দাসদের মত বাজারে তুলে বিক্রী করা যাবে না। সেটা ঠিক এখন আর আগের মত রাস্তার মোড়ে দাড় করিয়ে মানুষ বিক্রি করার দিন নেই। কিন্তু তাই বলে ধনিক শ্রেনী কর্তৃক অসহায় শ্রেনীকে দাস বানানোর প্রথা বন্ধ নেই। এখন আরো সুন্দর ও নান্দনিক ভাবে এইসব কাজ করা হয়। এখন আর ওদের কৃতদাস বলা হয় না ,বলা হয় house servant বা গৃহকর্মী। নামের পরিবর্তন হলেও ওদের জীবনের সাথে কৃতদাসের জীবনের কোনো পার্থক্য নেই। গৃহকর্মীরা সূর্যোদয় থেকে শুরু করে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত কাজ করতে বাধ্য হয়। সব মিলিয়ে কর্মঘন্টা হয় ১৬ থেকে ১৮ ঘন্টা, ক্ষেত্রবিশেষে যেটা ২০ ঘন্টা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তাদেরকে খেতে দেওয়া হয় ঘরের উচ্ছিষ্ট খাবার। তাদের জন্য নেই কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা, নেই কোনো বিনোদনের সুযোগ আর তার উপর আছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। গৃহকর্মীদের উপর যে নির্মম নির্যাতন করা হয় তা মধ্যযুগের অত্যাচারকেও হার মানায়। অত্যাচারের নতুন নতুন পদ্ধতির মধ্যে আছে ইলেক্ট্রিক শক, চোখে মুখে মরিচ ঘষে দেওয়া, গরম খন্তির ছেকা, আঙ্গুলে সূচ ফুটিয়ে দেওয়া, ঘুমাতে না দেওয়া ইত্যাদি। আর আছে নির্যাতনের আদিম ও বহুল প্রচলিত এক পদ্ধতি যৌন নির্যাতন। নির্যাতন যে শুধু বাসার কর্তী করেন তাই না। বাসার ছোট থেকে বড় সব সদস্যের বিনোদনের বিষয় হচ্ছে গৃহকর্মীকে নির্যাতন।

এই ধরনের নির্যাতনের কথা আমরা তখনই জানতে পারি যখন কিছু নির্যাতন কারী পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। কিন্তু সে হার খুব কম। গৃহকর্মীকে নির্যাতনের জন্য বছরে মাত্র দুই থেকে তিনজন গ্রেফতার হয়, অন্তত আমরা মিডিয়াতে তাই দেখি। কিন্তু তাদের কারও পরবর্তীতে শাস্তি হয়েছে এমন কোনো দৃষ্টান্ত দেখা যায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এইসব মামলা নির্যাতিতের পরিবারের সাথে মিটিয়ে ফেলা হয়, বা সহজ ভাষায় নির্যাতিতরা মিটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়।

কিন্তু একটা সমাজের এইধরনের নির্যাতন দিনের পর দিন চলতে পারে না। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এখনই দরকার। শ্রমদাসত্বমূলক এই প্রথা দূর করতে না পারলে শোষনহীন সুন্দর সমাজ কখোনোই গড়া সম্ভব হবে না। এই প্রথা দূর করার জন্য প্রথমেই যা করতে হবে তা হলো গৃহ শ্রমকে জাতীয় শ্রমনীতির আওতায় আনা। তবে শ্রমনীতির আওতায় আনা হলেও কিছু বিশেষ বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। কারন সাধারন শ্রমিকদের থেকে গৃহশ্রমিকদের ব্যাপারটা একটু আলাদা। সাধারন শ্রমিকদের মত গৃহশ্রমিকদের কর্মক্ষেত্র আর বাসস্থান আলাদা নয়। গৃহশ্রমিকরা তাদের কর্মস্থল অর্থ্যাৎ মালিকের বাসস্থানেই থাকে ফলে তার সমগ্র জীবনের উপর মালিকের প্রভাব থাকে। সেজন্য গৃহশ্রমিকরা যাতে তাদের শ্রম সংক্রান্ত অধিকারের সাথে সাথে জীবনের অন্যান্য অধিকার গুলোও পেয়ে থাকে সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখতে হবে। গৃহ শ্রমিক আইনে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে তা হলঃ

১। সাধারন শ্রমিক আইন অনুযায়ী প্রত্যেক গৃহশ্রমিকের কর্ম ঘন্টা হবে সর্বোচ্চ ৮ ঘন্টা। ৮ ঘন্টার অতিরিক্ত কাজ করালে ঘন্টা প্রতি দ্বিগুন হারে ওভার টাইম বেতন দিতে হবে। তবে কোনো অবস্থাতেই ওভারটাইম করার জন্য বাধ্য করা যাবে না।

২। গৃহশ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো ঘোষনা করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী বেতন দিতে হবে। এবং সেই বেতন নগদ অর্থমূল্যে পরিশোধ করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই জামা কাপড়, জুতা ইত্যাদি দ্বারা বেতন পরিশোধ করা যাবে না।

৩। গৃহ শ্রমিক যেহেতু মালিকের গৃহেই অবস্থান করে তাই তার খাবার এর ব্যাবস্থা মালিকের খাবারের সাথেই করতে হবে তা না হলে তাকে পৃথকভাবে রান্নাবান্নার সুযোগ দিতে হবে।

৪। প্রত্যেক গৃহশ্রমিককে বিনোদনের পর্যাপ্ত সুযোগ দিতে হবে। সাথে সাথে ঘুমানোর পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে।

৫। গৃহশ্রমিকদের সপ্তাহে নূন্যতম একদিন সাপ্তাহিক ছুটি দিতে হবে এবং এর জন্য কোনো প্রকার বেতন কাটা যাবে না।

৬। শ্রম আইন আনুযায়ী অন্যান্য ছুটি সমূহ গৃহশ্রমিকদের প্রদান করতে হবে। তবে ছুটির দিন যদি গৃহশ্রমিকরা মালিকের বিশেষ প্রয়োজনে কাজ করতে ইচ্ছুক থাকে তাহলে দ্বিগুন হারে ঘন্টা প্রতি পারিশ্রমিক প্রদান করতে হবে।

৭।গৃহশ্রমিকদের যেকোন ধরনের চিকিৎসা ব্যয় মালিককে বহন করতে হবে।

৮। দূর্ঘটনাজনিত কোনো প্রকার ক্ষয়ক্ষতির জন্য ( যেমন হাত থেকে পড়ে কাচের থালাবাসন ভেঙ্গে যাওয়া ) বেতন কাটা যাবে না।

৯। গৃহশ্রমিকদেরকে তাদের পরিবারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ও ফোনে কথা বলার সুযোগ দিতে হবে।

১০। গৃহশ্রমিকরা একমাসের নোটিশে কাজ ছেড়ে দিতে পারবে। কোনো অবস্থাতেই বাধ্যকরে কাজে বহাল রাখা যাবে না। সেই সাথে কাজ থেকে বাদ দিতে হলেও একমাস পূর্বে নোটিশ দিতে হবে।

১১। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার হচ্ছে কোনো অবস্থাতে এবং কোনো অজুহাতেই গৃহকর্মীদের শারীরিক এবং মানসিক ভাবে নির্যাতন করা যাবে না। এইধরনের যেকোন প্রকার নির্যাতন ফৌজদারী অপরাধ বলে গন্য হবে। এক্ষেত্রে গৃহকর্মীদেরকে রাষ্ট্র কর্তৃক আইনি সহায়তা দিতে হবে। নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মীরা যাতে সহজে অভিযোগ জানাতে পারে তারজন্য একটি হট লাইনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সাথে সাথে প্রত্যেক গৃহকর্মীকে পরিচয় পত্র প্রদান করতে হবে যাতে বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্র কর্তৃক তাদের খোজখবর রাখা যায়।

পরিশেষে এটাই বলতে চাই গৃহকর্মীরা আমাদের সমাজেরই মানুষ। এবং আমাদের সমাজের জন্য তারা খুবই গুরুত্বপূর্ন। গৃহকর্মীদের ছাড়া আজকের কর্পোরেট শ্রেনীর মানুষরা আসহায়। তাই আমাদের জাতীয় আয়ে পরোক্ষভাবে হলেও তাদের বিশাল অবদান আছে। সমাজের এইসব শ্রমজীবি মানুষকে নির্যাতন ও নিপীড়ন করে, তাদের অধিকার বঞ্চিত রেখে আমরা শুধু একটি অমানবিক ও নিষ্ঠুর সমাজই তৈরী করতে পারবো। তাই সুন্দর সমাজ গড়তে দেশের সব সচেতন মানুষকেই এই ধরনের শোষনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।