আমাদের সমাজে
সোস্যাল ওয়ার্ক নামে একটি কথা প্রচলিত আছে। যার মানে হচ্ছে সমাজের জন্য কিছু করা।
এই সোস্যাল ওয়ার্কের আওতায় যেসব কাজ করা হয় তার মধ্যে হচ্ছে শীতকালে দরিদ্রদের
মধ্যে কম্বল বিতরন করা, বন্যার্তদের মাঝে ত্রান বিতরন, সপ্তাহের বিশেষদিনে অসহায়
মানুষদের মধ্যে বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান, সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের বিনামূল্যে
পাঠদান ইত্যাদি ইত্যাদি ...। আপাত দৃষ্টিতে এইসব কাজকে খুব মহৎ মনে হলেও এর মাঝে
একধরনের আত্মতৃপ্তি ও আত্মপ্রবঞ্চনার ব্যাপার আছে। এর মধ্যে দিয়ে সমাজের সংকট
গুলোকে মেনে নেয়ার একধরনের মানসিকতা প্রকাশ পায়।
ব্যাপারটি একটু
ভালো করে লক্ষ্য করি। যখন গরিব মানুষদের মধ্যে কম্বল বা এইজাতীয় কোনো কিছু বিতরন
করা হয় তখন আসলে কি চিন্তা কাজ করে? চিন্তাটি হচ্ছে যেহেতু সমাজের একশ্রেনীর মানুষ
খুব দুঃখ কষ্টের মাঝে আছে তাই তাদের একটু সাহায্য করি, আমাদের সাহায্য ও সহযোগিতায়
তাদের মুখে একটু হাসি ফুটুক। অনেকে ব্যাপারটা খোলাখুলি ভাবেই প্রকাশ করে “ওদের
মুখে হাসি দেখাতেই আমার আনন্দ”। এই ধরনের সাহায্য সহযোগিতায় সবসময় দুটো পক্ষ থাকে।
একজন দাতা আর একজন গ্রহীতা, দাতা সবসময় দান করে তার মহত্বের পরিচয় দিয়ে যাবেন আর
গ্রহিতা সবসময় হাত পেতে দান গ্রহন করে আত্মগ্লানিতে ভুগবেন। এর ফলে দাতাদের মধ্যে
একধরনের আত্মতৃপ্তি কাজ করে। আহা আমি কত মহৎ, আমি কত জনদরদি, আমি মানুষের জন্য
ভাবি... ইত্যাদি। এইধরনের দান ও সাহায্য শেষ পর্যন্ত ঐ মানুষ গুলোর জীবনে কোনো
পরিবর্তনই আনতে পারে না। উপরন্তু যেটা তাদের অধিকার সেটা দান হিসেবে পেয়ে তারা নিজেদের
ধন্য মনে করে। সমাজে মানুষে মানুষে যে শ্রেনীবিভেদ , মানুষের প্রতি মানুষের যে
শোষন সেটাকে দূর না করে এই ধরনের দান ও সাহায্য শেষ পর্যন্ত এই বৈষম্যমূলক সমাজের
পক্ষেই কাজ করে।
এইধরনের কাজ যে
শুধু নিরর্থক তাই না, এর একটা নেতিবাচক প্রভাবও তরুন সমাজের মধ্যে পরে। যে তরুনদের
কাজ হচ্ছে নিজের মেধা, শিক্ষা ও পরিশ্রম দ্বারা সমাজের বৈষম্যগুলোকে দূর করে একটা
সুন্দর সমাজ গড়ে তোলা সেই তরুনরা এই ধরনের নিরর্থক কাজ করে মনে করে সমাজের প্রতি
তাদের দায়িত্ব শেষ। ফলশ্রুতিতে দেখা যায় সারারাত ধরে ত্রানের কম্বল বিতরন করে
তরুনরা পরেরদিন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছে “ অসাধারন একটা দিন কাটালাম” , “আজ বুঝতে
পারলাম এই মানুষগুলো নিয়তির কাছে কি অসহায়”... । এই ধরনের বিভিন্ন নাকি কান্না
মূলক কথাবার্তা বলতে থাকে। সমাজের প্রতি নিজের দৃষ্টিভঙ্গি পরিস্কার না থাকার কারনে
সারারাত ধরে কম্বল বিতরন করা ছেলেটিই তার বাস্তব জীবনে বিভিন্ন শোষন মূলক কর্মকান্ডে
জড়িত থাকে। উদাহরন স্বরূপ ধন্যাঢ্য পিতার ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া ছেলে বা মেয়েটি
সারাদিন ফুল বিক্রি করে সেই টাকায় ছিন্নমূল শিশুদের একদিনের খাবার যোগালেও (এই
বিশেষ দিনে ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র ছাত্রীরা বিশেষ ধরনের টি শার্ট পরে এবং পরদিন
পত্রিকায় ওদের ফুল বিক্রির ছবি ছাপা হয়) সে বুঝতে পারে না তার বাবার ফ্যাক্টরিতেই
হাজার হাজার শ্রমিকের শ্রম চুরি করা হচ্ছে প্রতিদিন, সেই শ্রমচুরির টাকাতেই সে
মার্সিডিজ বেঞ্জ হাঁকায়। অনেকে আবার এই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেও তার শ্রেনীগত
অবস্থানের কারনে এইধরনের শোষনের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় না, কম্বল বিতরনের মাঝেই সে তার
কর্তব্য সারে।
এতো গেলো
উচ্চবিত্ত পরিবারের সৌখিন তরুনদের কথা, মধ্যবিত্ত পরিবারের অনেক তরুনও এই ধরনের
ত্রান বিতরন জাতীয় কাজে নিজেদের নিয়োজিত করে। এরা ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন কর্পোরেট
কোম্পানীর দ্বারা। এইসব কর্পোরেট গোষ্ঠীরা সমাজ সেবার নামে সমাজের মধ্যে নিজেদের
গ্রহনযোগ্যতা বাড়িয়ে তোলে। গরীবের রক্তচুষে জমানো টাকায় গরীবকে সান্তনা সূচক ত্রান
বিতরন করে, অনেকটা গরু মেরে জুতা দানের মত। এর একটা সুন্দর নামও আছে, ওদের ভাষায়
সিএসআর অর্থাৎ কর্পোরেট সোস্যাল রেস্পন্সিবিলিটি। দেশের স্বার্থবিরোধী এই সব
কোম্পানী ওদের অপকর্ম ও শোষনকে নির্ভীগ্নে চালিয়ে যাওয়ার স্বার্থে দেশের মানুষকে
চোখে ধুলো দিতে এইসব কাজ করে থাকে। আর এইসব কর্মকান্ডকে সাধারন মানুষের কাছে
সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করে কর্পোরেট গোষ্ঠীর পোষা মিডিয়া। মানব সেবার পাশাপাশি এরা
তরুনদের ভেতর একধরনের ভোগবাদী মানসিকতা তৈরী করে। সামাজিক দায়িত্ব ভুলে তরুনরা
পরিনত হয় সৌখিন সমাজ কর্মীতে। ফলে এই ধরনের তরুনরা ত্রান বিতরনে যতটা আগ্রহী ঠিক
ততোটাই অনাগ্রহী সমাজ পরিবর্তনের কাজে আত্মনিয়োগ করতে।
এখন মনে প্রশ্ন
আসতে পারে মানুষ যখন বিপদে পরে তখন কি আমরা হাতপা গুটিয়ে বসে থাকবো? না তা অবশ্যই
নয়। মানুষ হিসেবে সব সময়ই আমাদের মানুষের পাশে দাড়াঁতে হবে। কিন্তু তা যেনো শুধু
কম্বল বিতরনের মাঝে সীমাবদ্ধ না থাকে। আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে এই ধরনের
সাহায্য সব সময়ই একটা অস্থায়ী টোটকা ব্যবস্থা। পুরো সমাজ জুড়ে চলা শোষন দূর করতে
না পারলে এই ধরনের সংকট সব সময়ই থেকে যাবে। তাই তরুনদের বুঝতে হবে শুধু কম্বল বা
বিনামূল্যে স্যালাইন বিতরন করলেই আমাদের দায়িত্ব শেষ না। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে এই
সমাজের প্রতিটি স্তরে চলা অমানবিক শোষন ও অবিচার দূর করে সমধিকার ভিত্তিক একটি
মানবিক সমাজ গঠন করা। সাথে সাথে এটাও মনে রাখতে হবে কর্পোরেট গোষ্ঠী যতই সোস্যাল
রেস্পন্সিবিলিটির কথা বলুক না কেনো, ওদের মূল উদ্দ্যেশ্য হচ্ছে মুনাফা করা। আর ওদের
মুনাফার জন্য একমাত্র শর্ত হচ্ছে এই শোষন মূলক ব্যবস্থাটাকে জারি রাখা। তাই এই
শ্রেনী কর্পোরেট শোষক ও তাদের তাবেদার মিডিয়ার মুখোশ খুলে দিতে না পারলে ও তাদের
প্রতিহত করতে না পারলে এই শোষন কোনো দিনই দূর হবে না। উদাহরন স্বরূপ কিছুদিন আগে
এশিয়া এনার্জির কর্মকর্তা গ্যারী লাই ফুলবাড়িয়াতে ত্রান বিতরন করতে গেলে সাধারন
মানুষের প্রতিরোধের মুখে পালিয়ে বাঁচে। কারন মানুষ বুঝতে পেরেছিলো ত্রানের আড়ালে
ওদের উদ্দেশ্য হচ্ছে ফুলবাড়িয়ার কয়লা খনি থেকে উন্মুক্ত পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন।
এভাবে আমাদের সব সুবিধাবাদী গোষ্ঠিকে প্রতিহত করতে হবে। যাতে আর কেও কম্বলের বিনিময়ে আমাদের মূল্যবান সম্পদ হাতিয়ে
নিতে না পারে।
সবশেষে একটা কথাই
বলতে চাই, সমাজ পরিবর্তন করে শোষনহীন সমাজ গড়তে হলে সবার প্রথমে নিজের শ্রেনী
অবস্থান ত্যাগ করে , সকল প্রকার ভাবগত ও বস্তুগত সম্পদ চর্চা বাদ দিয়ে সমাজ
পরিবর্তনের কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। তবেই সম্ভব হবে একটি সুন্দর, মানবিক ও আধুনিক
সমাজ গড়া।