পোস্টকার্ড ব্লগের “ লোকায়ত কথোপকথন ” পাতাটি সবার জন্য উন্মুক্ত । লিখতে চাইলে আমাদের মেইল করে জানান । সাগ্রাহে আমরা আমান্ত্রন জানাবো। আমাদের মেইল ঠিকানা postcarduv@gmail.com। বাছাইকৃত লেখাটি পোস্ট কার্ড সংখ্যায় প্রকাশ করা হবে।

রবিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৪

অদৃশ্য বিষের ছোবল

“মা, ফুলে কি ফরমালিন আছে?”, বলছিল ছয় বছরের স্কুল পড়ুয়া ফারিয়া, বাড়ির ছাদে ফুল বাগানে মায়ের সাথে হাঁটতে গিয়েমা বলল, “কেন মা হঠাৎ এই প্রশ্ন?” “না, মা তোমরাই তো বল এখন সবকিছুতেই ফরমালিন...” ছোট শিশুও আজ ফরমালিন নামক বিষের কথা জেনে গেছে, যা কয়েক বছর আগেও ছিল আমাদের জানার বাইরে।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ফলমূল, শাক-সবজি, মাছ-মাংস, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য থেকে শুরু করে চাল, ডাল, হলুদের গুঁড়া, লবণ, ফাস্টফুড, কোমল পানীয় সবকিছুতেই ফরমালিন ও বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থের ছোবলে বিষময়। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও) এবং বাংলাদেশ সরকারের যৌথ ব্যবস্থাপনায় গড়ে তোলা দেশের সর্বাধুনিক খাদ্য নিরাপত্তা গবেষণাগারে পরীক্ষায় দেশের ৪০ শতাংশ খাদ্যেই ভয়ংকর সব ভেজাল ও বিষাক্ত রাসায়নিকের প্রমান মিলেছে। যার মধ্যে নিষিদ্ধ ডিডিটি থেকে শুরু করে রয়েছে বেনজয়িক এসিড, অ্যালড্রিন, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক, সিসা, ফরমালিন ইত্যাদির মত ভয়ংকর উপাদান। তাহলে এসব খাদ্য গ্রহনের পূর্বে আমরা কি একবারও প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছি না, কি খাচ্ছি? বা আমাদের পরিবার বা সন্তানের মুখে কি ঢেলে দিচ্ছি??!! আজ শ্বাসকষ্ট, পলিপাস, হাতে-পায়ে ব্যাথা, গ্যাসট্রো-ইন্টেস্টাইন্যাল ডিজিজ, কিডনি ডিজিজ, ফুসফুস ক্যান্সার, লিউকেমিয়া, ইউরিনারীট্রাক্ট জনিত সমস্যাগুলো কেন বাড়ছে? পরিবারের সদস্যরা প্রায়ই অসুস্থ থাকছে আর খরচ হচ্ছে হাজার হাজার টাকা।

তাহলে কি খাবো? প্রশ্ন সবারই...। চলুন বৃষ্টির পানি বা বাতাস খেয়ে বাঁচা যাক...! কিন্তু সেটাও কি নিঃসংশয়ে নিতে পারব?? সৃষ্টিকর্তার দান এই সম্পদগুলোও যে আমাদের মনুষ্য জগতের বিষাক্ত ছোবল থেকে রক্ষা পায় নি। পরিবেশ দূষণ, বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, খাদ্য বিষক্রিয়ার ফলে এসিড বৃষ্টি হচ্ছে, বাতাসে মিশে আছে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, সালফার-ডাই-অক্সাইড, লেড, সীসা ইত্যাদি। আমরা ক্রেতাগন বাজারে বাহারি রঙের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ক্রয় করছি কার্বাইড, ইথিলিনযুক্ত পাকা আম, কাঁঠাল, তরমুজ, পেঁপে, লিচু, বরই, দাগ-মুক্ত ফল, শাক-সবজি ইত্যাদি। ভেজাল মিশ্রণকারীদের আমরাই কি উৎসাহিত করছি না? আজ নিরক্ষর বা স্বল্প শিক্ষিত কৃষকের ফসলের ন্যায্য মূল্য না দিয়ে তাদের অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে তুলে দিচ্ছি আমরা শিক্ষিত সমাজ ক্ষতিকর কীটনাশক, রাসায়নিক পদার্থ। বিশেষজ্ঞরা জানান, কৃষি বলতে কেবল ফসলই নয়, মৎস্যসম্পদও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মৎস্য সম্পদ অধিদপ্তরের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে মাছে ব্যবহৃত কীটনাশকের মধ্যে ৬০ শতাংশ চরম বিষাক্ত, ৩০ শতাংশ একটু কম আর ১০ শতাংশ বিষাক্ত নয়। এছাড়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, দেশে প্রতিবছর বৈধ ভাবে প্রায় ২৭ হাজার টন কীটনাশক ব্যবহার হচ্ছে। এছাড়া বিশ্বব্যাংক ২০০৭ সালে এ প্রতিবেদনে বলেছিল বাংলাদেশের ৪৭ শতাংশেরও বেশি কৃষক ফসলে প্রয়োজনের বেশি কীটনাশক ব্যবহার করে। তাহলে এর সমাধান কি হতে পারে? জনগণ ও সরকারকেই এর সমাধান বের করতে হবে। সরকার যদি কৃষকের উৎপাদিত পণ্য ভোক্তার নিকট সরাসরি উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সঠিক সংরক্ষণ পদ্ধতির মাধ্যমে পৌঁছে দিত, উৎপাদন থেকে বিপণন পর্যন্ত মধ্যসত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ন্যকে অবরোধ করতে পারত তাহলে আমাদের কৃষক কি নিজেদের সোনার ফসলকে বিষের ফসলে রূপান্তরিত করতে পারত?

বর্তমানে সমাজে সম্পদের অপ্রতুলতা, অসৎ ব্যক্তিদের মুনাফাধর্মী ব্যবসার কারণে আমরাও যেন আমাদের ন্যায়বোধ হারিয়ে কোন মরীচিকার পিছনে ছুটছি। তবুও আজও ভালো, সৎ, ন্যায়বান মানুষ আছে সমাজে, হয়তো বা তাদের সংখ্যা খুব কম। সুশীল সমাজ ও সচেতন নাগরিকগণ সবাইকেই সম্মিলিতভাবে এগিয়ে এসে সমস্যা সমাধানে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।

এ তো গেল আপনার জনসাধারণের কথা, এবার সরকারের দিকে নজর দিই। রাষ্ট্র ও সরকার কি আমাদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে পারছে, যেখানে খাদ্য আমাদের মৌলিক চাহিদা। গ্রাম ও শহর দুটোই এ ভেজালে আক্রান্ত যদিও গ্রামে তুলনামূলকভাবে কম। সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার উপর কি সঠিক তদারকি বর্তায় না? যদিও তাদের মতে আধুনিক যন্ত্রপাতি ও লোকবলের অভাব। আবার এই ভেজাল বিরোধী অভিযানে তারাই কতিপয় স্বার্থান্বেষী লোকের অর্থলোভে ভেজাল মিশ্রিত হয়ে যাচ্ছে। ভেজাল বন্ধে ‘খাদ্য নিরাপত্তা আইন ২০১৩’ প্রণীত হলেও তা এখনও বিধি হয়নি। তাই সরকার যদি সরাসরি তদারকি ও কঠিন আইন কার্যকর করার মাধ্যমে ও রাজনৈতিক সহিংসতা প্রত্যাহার করে রাষ্ট্রের গুরুদায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করে তবেই হয়তো সবার সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সম্ভবপর হবে।

ফারজানা লিমা
কৃষি অনুষদ, ২য় বর্ষ
শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
শেরে বাংলা নগর, ঢাকা ।

বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন, ২০১৪

খুশবন্ত সিংয়ের মার্ক্সবাদের অপব্যাখ্যা

সম্প্রতি আমার হাতে ভারতের বিখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক খুশবন্ত সিং এর একটি বই এসে পড়েছে। বইটি সিংজীর নির্বাচিত সেরা লেখা নিয়ে নাম হচ্ছে ‘দি ভিনটেজ সরদার’। অনুবাদ করেছেন আনোয়ার হোসেইন মঞ্জু আর প্রকাশ করেছে ‘ঐতিহ্য’ প্রকাশনী। বইটিতে দেখলাম বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সিল মারা অর্থ্যাৎ এটি তাদের পাঠাগারের তালিকাভুক্ত বই। বইটি মূলত বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খুশবন্ত সিং এর বিভিন্ন লেখার সংকলন।



বিভিন্ন বৈচিত্রময় বিষয় নিয়ে লিখেছেন খুশবন্ত সিং। তার মধ্যে একটি লেখার নাম ‘মার্ক্সও নয় ঈশ্বরও নয়’। আমার আলোচনা মূলত এই লেখাটি নিয়ে। লেখার শুরুতেই সর্দার জী বলেছেন যে ঈশ্বর ও কার্ল মার্ক্স দুজনেই নাকি তাকে হতাশ করেছেন। এই লেখায় তিনি যে শুধু যে তার হতাশাই প্রকাশ করেছেন তাই নয় তিনি মার্ক্সবাদের এক বিকৃত ব্যাখ্যাও দিয়েছেন। তার সেই বিকৃত ব্যাখ্যার স্বরুপ উন্মোচন করার জন্যই মূলত এই আলোচনার অবতারনা। বিস্তারিত ব্যাখ্যার আগে চলুন দেখে নেই মার্ক্সবাদ কে
নিয়ে সিংজী কি বলছেন। সিংজীর মতামত গুলো নিন্মরুপ:

১. মার্ক্স ঘোষণা করেছিলেন শ্রেণী সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে পুঁজিবাদের পতন ঘটবে এবং বিজয় লাভ করবে প্রলেতারিয়েত শক্তি। সর্দারজীর মতে মার্ক্সের ভবিষ্যতবাণী ভুল হয়েছে। বহু রাষ্ট্রে পুঁজিবাদ সুদৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে।

২. ব্যাক্তিমালিকানায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের চাইতে দক্ষতার সাথে পরিচালিত হয় বলে প্রমাণিত।

৩. শ্রমিকদের সাথে আচরণের ক্ষেত্রেও ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানই অধিকতর সদয়। পুঁজিবাদী দেশগুলোতে শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন গঠন এবং তাদের অধিকার আদায়ের জন্যে ধর্মঘট করার ব্যাপারে স্বাধীন। কিন্তু কমিউনিস্ট দেশগুলোতে এসব ক্ষেত্রে তারা স্বাধীন নয়।

৪. অধিকাংশ কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হিটলারের জার্মানির মতো একনায়কতন্ত্র। তাদের বন্দিশিবিরে বন্দিদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়।

৫. “মার্ক্সবাদীরাই কার্ল মার্ক্সের বদনামের জন্য দায়ী। তারাই কাজে ফাঁকি দিয়ে ‘কামচোর’ হিসেবে কুখ্যাতি অর্জন করেছে। উইল রজার্স যথার্থই মন্তব্য করেছেন যে, কমিউনিস্টরা যে দৃঢ়তার সাথে কথা বলে, একইভাবে তারা যদি কাজ করতো তাহলে বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ সরকার তারাই গড়তে পারতো। কিন্তু তারা তাদের তত্ত্বের এক তৃতীয়াংশ প্রয়োগ, আর দুই তৃতীয়াংশ ব্যাখ্যা করে কাটায়। একজন কমিউনিস্ট সম্পর্কে এবেনেজার এলিয়ট বলেছেন:

“ কমিউনিস্ট কি? যে অসম উপার্জনের সমান বিভাজনের কথা বলে, আলস্যে কাটায় অথবা তালগোল পাকায় অথবা ইচ্ছা হলে দুটোই করে। নিজের পেনির বদলে আপনার শিলিং পকেটস্থ করে”।

এবার সর্দারজীর মন্তব্যগুলো একটু বিশ্লেষণ করা যাক। এই মন্তব্যগুলো ব্যাখ্যা করার সময় আমাদের মনে রাখতে হবে সর্দারজী তার প্রবন্ধে স্বীকার করে নিচ্ছেন তিনি মার্ক্সের সব লেখা পড়েন নি। এবং ‘ডাস ক্যাপিটাল’ এর কঠিন ভাষার কারণে পড়ে বুঝতে পারেননি (তার এই সরল স্বীকারোক্তির কারণে তাকে ধন্যবাদ, যদিও সেটা স্বীকার না করলেও সমস্যা ছিলো না কারণ তার লেখাগুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা বুঝতে পারবো যে তিনি আদতেই মার্ক্সবাদ বুঝেন না। আর সব বই না পড়ার ব্যাপারটাও খুব সাধারণ কারণ সমালোচক মাত্রই জানেন যে মার্ক্সকে সমালোচনা করতে হলে মার্ক্সের লেখা পড়ার কোন দরকার নেই। শুধু জায়গামতো ক্ষোভ ঝেড়ে দিলেই হলো।)

এবার প্রথম পয়েন্টটি লক্ষ্য করি যেখানে সর্দারজী বলছেন পুঁজিবাদের পতনের মার্ক্সের ভবিষ্যৎবাণী ভুল হয়েছে, এবং বহু রাষ্ট্রেই পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত। এক্ষেত্রে প্রথমেই মনে রাখা উচিত মার্ক্স কোন ভবিষ্যৎ বক্তার মতো ভবিষ্যৎবাণী করেননি। তিনি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে তাত্ত্বিকভাবে ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন যে পুঁজিবাদের পতন অবশ্যম্ভাবী। এবং মার্ক্সের মৃত্যুর মাত্র ৩৫ বছরের মাথায় ১৯১৮ সালে রাশিয়ায় লেনিনের নেতৃত্বে অক্টোবর বিপ্লবের বিজয়ের মাধ্যমে প্রমাণ হয়েছিলো মার্ক্সের তত্ত্বের সত্যতা। এখানে লক্ষ্যনীয় যে খুশবন্ত সিং যখন এই প্রবন্ধটি লিখেন (১৯৮৮) তখনও সোভিয়েত রাশিয়ার পতন হয়নি। সোভিয়েত রাশিয়ার পতন হলেই কি মার্ক্সীয় তত্ত্ব ভুল বলে প্রমানিত হয়। বিজ্ঞানের ছাত্র মাত্রই জানে ভুলভাবে প্রয়োগের কারণে কোন তত্ত্বই ভুল প্রমাণিত হয় না। আপাত ভুল গুলোকে শুধরে নিয়ে তত্ত্বকে সঠিকভাবে প্রয়োগ করা যায়। সর্দারজী মার্ক্সীয় তত্ত্বের ভুলের কোন তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। শুধু তাই নয় রাশিয়ান বিপ্লবের মাধ্যমে যে প্রমাণ হয়েছে মার্ক্সের তত্ত্বের সত্যতা তাও তার চোখে পড়ে না। চীনের জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবও তাকে আলোড়িত করে না এমনকি বিপ্লবের মাধ্যমে কিউবার নতুন সমাজ গড়ার দৃষ্টান্তও তার চোখ এড়িয়ে যায়। তিনি শুধু দেখেন পুঁজিবাদের ঝাঁ চকচকে খোলসটা।


এবার দ্বিতীয় পয়েন্টটার দিকে নজর দেই যেখানে সর্দারজী বলছেন রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান থেকে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো অধিক দক্ষতার সাথে পরিচালিত হয়। এই ব্যক্তব্যের মাধ্যমে খুশবন্ত সিং প্রমাণ করলেন মার্ক্সবাদ সম্পর্কে তার ধারণা কত অপরিনত। কোন প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন হলেই কি সেখানে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়ে যায়? তিনি যে উদাহরণ দিলেন তা হলো পুঁজিবাদী কাঠামোর মধ্যে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে মুষ্টিমেয় পুঁজিপতিদের শ্রেনী স্বার্থ রক্ষা করা সেখানে উদ্দেশ্যমূলক ভাবেই রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গুলোকে অকেজো করে রাখা হয়। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান আর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিষ। এখন পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের ব্যর্থতাকে সমাজতন্ত্র বা মার্ক্সবাদী তত্ত্বের ব্যর্থতা হিসেবে আখ্যায়িত করা কতটা যুক্তিসঙ্গত?

এবার তিন নাম্বার পয়েন্টটা দেখি যেখানে খুশবন্ত সিং বলছেন শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান বেশী সদয়। উদাহরণ স্বরুপ তিনি দেখাচ্ছেন ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারে এবং ধর্মঘট করার ব্যাপারে তারা স্বাধীন। সিংজীর এই বক্তব্যটিও যথেষ্ট বিভ্রান্তিপূর্ণ। প্রথমেই মনে রাখতে হবে ট্রেডইউনিয়ন করা কিংবা ধর্মঘটের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য শ্রমিকদের প্রচুর সংগ্রাম করতে হয়েছে। বহু রক্তের বিনিময়ে শ্রমিকরা তাদের এই অধিকার গুলো আদায় করে নিয়েছে। অথচ সিংজী ট্রেডইউনিয়ন করার অধিকারকে পুঁজিবাদের কৃত্তিত্ব হিসেবে দেখছেন। পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থায় শ্রমিকদের শ্রমে উৎপন্ন উদ্বৃত্তমূল্য আত্মসাৎ করে অধিক মুনাফা অর্জনের মাধ্যমে মালিক শ্রেনী শ্রমিক শ্রেনির উপর যে শোষণ চালায় যে ব্যাপারি সিংজী নিশ্চুপ, তিনি শুধু পুঁজিবাদের মানবিক দিক আবিস্কার করতেই ব্যস্ত। সিংজীর আরেকটি বক্তব্য হচ্ছে কমিউনিস্ট রাষ্ট্রে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার নেই। এই বক্তব্যের মাধ্যমে সিংজী আবারো সমাজতন্ত্রের ব্যাপারে তার অস্পষ্ট ধারণার প্রমাণ রাখলেন। সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হচ্ছে শ্রমিকশ্রেনীর পরিচালিত রাষ্ট্র যেখানে ব্যক্তি মালিকানা নেই। যেখানে ব্যক্তিমালিকানা নেই সেখানে পুঁজিবাদী শোষণও নেই। যেখানে পুঁজিবাদী শোষণ নেই সেখানে ট্রেড ইউনিয়ন করা হবে কার বিরুদ্ধে। সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উৎপাদন পরিচালিত হয় সমবায়, যৌথখামার ইত্যাদির মাধ্যমে। যেখানে সকল গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহনে শ্রমিকরা সরাসরি অংশগ্রহণ করে। শ্রমিকদের সরাসরি অংশগ্রহনে ও নেতৃত্ত্বে যে রাষ্ট্র পরিচালিত হয় সেখানে দাবিদাওয়া আদায়ের মতো ব্যাপারটি অবশ্যই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মতো বৈরী পরিবেশে হবে না যা সিংজী উপলব্ধি করতে পারেননি।

চতুর্থ পয়েন্টে সিংজী বলছেন অধিকাংশ কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হিটলারের জার্মানীর মতো যেখানে বন্দী শিবির গুলোতে বন্দীদের ‍উপর অমানবিক আচরণ করা হয়। এই বক্তব্যটি হচ্ছে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিপক্ষে পুঁজিবাদী দেশ ও তাদের মিডিয়ার বহুল প্রচলিত অপপ্রচার গুলোর একটি। বড় বড় গুটিকয়েক কর্পোরেট গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া বহুবছর ধরেই এই ধরনের অপপ্রচার চালিয়ে আসছে, যার মাধ্যমে তারা মহান নেতা স্তালিন ও মাও সে তুংকে খুনী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। অথচ এসবের বিপক্ষে কোন প্রমান তার কখোনো দিতে পারে নি। লক্ষ্য করলে দেখবো পৃথিবী জুড়ে বড় বড় গনহত্যা গুলো সব সময়ে সংগঠিত হয়েছে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর মদদে। দুটি বিশ্ব ‍যু্দ্ধও হয়েছে সাম্রাজ্যবাদীদের অভ্যন্তরীন স্বার্থ হাসিলের জন্য। মানব ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকান্ড হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমানবিক বোমা হামলা কারা করেছে? সারা পৃথিবী জুড়ে ঔপনিবেশিক শোষণ কারা চালিয়েছে? আরও কাছের উদাহরণ দিলে বলা যায় শিখদের স্বর্ণ মন্দিরে হামলা করার কারনে সিংজী যে পদ্মভূষণ পদক ফিরিয়ে দিলেন সেই হামলাটি হয়েছিল কোন ব্যবস্থার রাষ্ট্র দ্বারা? সমাজতান্ত্রিক না পুঁজিবাদী?


পঞ্চম পয়েন্টটি খুব গুরুত্বপূর্ণ যেখানে সিংজী কমিউনিস্টদের ‘কামচোর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এখানে তিনি বাস্তবিকই তার ব্যক্তিগত ক্ষোভ ঝেড়ে দিয়েছেন। কমিউনিস্টরা কিভাবে ‘কামচোর’ তিনি সে ব্যাখ্যায় না যেয়ে ‘উইল রজার্সের’ বক্তব্য উল্লেখ করেছেন যেখানে রজার্স বলছেন কমিউনিস্টরা যদি সঠিকভাবে কাজ করতো তাহলে তারাই সবচেয়ে সমৃদ্ধ রাষ্ট্র গড়তে পারতো। আমাদের প্রশ্ন কমিউনিস্টরা কি তাদের অক্লান্ত শ্রমের দ্বারা প্রথিবীর সবচেয়ে সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের উদাহরণ তৈরী করে নি? অক্টোবরের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মাধ্যমে কমিউনিস্টরা কি পশ্চাৎপদ ও গ্রামীণ অনুন্নত কৃষি ভিত্তিক রাশিয়াকে বিশ্ব দরবারে প্রতিষ্ঠিত করেনি? মাও সে তুং এর মহান জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের পূর্বে যে চীনকে সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো তাদের লুটপাটের জন্য নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছিল সেই চীন কি আজ মাথা উচু করে দাঁড়ায়নি? ফিদেল কাস্ট্রো ও চে গুয়েভারার নেতৃত্ত্বে কিউবার বিপ্লবের পর দরিদ্র কিউবাতে কি সাম্যের সমাজ প্রতিষ্টিত হয়নি? না, এই বিষয়গুলো আমাদের সিংজীর চোখে পড়েনি। উল্টো কমিউনিজমের গুরুত্বপূর্ণ নীতি ‘মানুষ কাজ করতে তার সাধ্য অনুযায়ী আর পাবে তার প্রয়োজন অনুযায়ী’ -কে বিকৃতভাবে উপস্থাপণ করেছেন। তিনি বলেছেন কমিউনিস্টরা নিজের পেনির বদলে অন্যের শিলিং আত্মসাৎ করে। সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় যেখানে কোন শ্রেনী শোষণই থাকে না সেখানে কিভাবে নিজের পেনির বদলি অন্যের শিলিং আত্মসাৎ করা যায়। তার কি কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে? অথচ পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় পুঁজিপতি বুর্জোয়া শ্রেনী অন্যের শ্রম চুরির টাকায় তার পুঁজির ভান্ডার গড়ে তোলে, আবার সেই পুঁজিকে ব্যবহার করে তার শোষনের হাতিয়ার হিসেবে। অথচ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এই শোষণমূলক চরিত্রকে সিংজীর কাছে মনে হয় অধিক বেশী মানবিক।

তানভীর হাসান অনিক
ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক