পোস্টকার্ড ব্লগের “ লোকায়ত কথোপকথন ” পাতাটি সবার জন্য উন্মুক্ত । লিখতে চাইলে আমাদের মেইল করে জানান । সাগ্রাহে আমরা আমান্ত্রন জানাবো। আমাদের মেইল ঠিকানা postcarduv@gmail.com। বাছাইকৃত লেখাটি পোস্ট কার্ড সংখ্যায় প্রকাশ করা হবে।

বুধবার, ২৭ মার্চ, ২০১৩

শিক্ষাঃ অধিকার ও বানিজ্য




আমরা সবাই জানি শিক্ষা হচ্ছে মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। ধর্ম, বর্ন, জাতি নির্বিশেষে সকলেরই শিক্ষা পাওয়ার অধিকার আছে। যদিও তা কাজীর গরুর মত আজ অবধি কিতাবেই হয়ে গেছে। সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকেই শিক্ষা কখনো সাধারন মানুষের জন্য ছিল না। ইংরেজ শাসক গোষ্ঠি এই উপমহাদেশে যতটুকুই শিক্ষার বিস্তার করেছিল পুরোটাই ছিল তার শাসন কার্যের স্বার্থে। তারা চেয়েছিল ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত এক শ্রেনীর মানুষ তৈরী করতে যারা জাতিতে ভারতীয় হলেও চিন্তায়, মননে, বুদ্ধিতে ও রুচিতে হবে ইংরেজ। বলা বাহুল্য এই কাজে ব্রিটিশ রাজ সফল হয়েছিল। তাদের ছত্রছায়ায় ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত কিছু বাবু নাম ধারী মানুষ আত্মপ্রকাশ করেছিল যাদের কাজ ছিল শোষকদের স্বার্থরক্ষা করা। ফলে এই শিক্ষার সুযোগ কখনোই সাধারন মানুষ পায়নি। ব্রিটিশরা একাধারে মানুষকে শোষন করবে সাথে সাথে সাধারন মানুষের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করে তাদের অধিকার সচেতন করে তুলে নিজের পতন নিজেই ডেকে আনবে সেই চিন্তাটাই হাস্যকর। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। শোষিত জনগন শোষনের যাতাকলে পিষ্ট হয়েছে আর দালাল বাবু শ্রেনী তার প্রভুদের পদলেহন করে গেছে। 

তারপর ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হলো। সেই আধা ঔপনিবেশিক পাকিস্তান রাষ্ট্রেও কোনো জনবান্ধব শিক্ষানীতি প্রনীত হয়নি। সেখানেও শিক্ষাকে বানিজ্যের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে সাধারন মানুষকে শিক্ষার আওতার বাইরে রাখা হয়েছিল। ১৯৫৯ সালের শরিফ কমিশনের রিপোর্টে শিক্ষার বানিজ্যিকী করনের বিষয়টি স্পষ্ট ভাষায় স্বীকার করা হয়েছে। বলা হয়েছে, “...শিল্পে মূলধন বিনিয়োগকে আমরা যে নজরে দেখি অনেকটা সেই নজরে শিক্ষাবাবদ অর্থ ব্যয়কে দেখার, অর্থাৎ উহাকে জাতীয় সম্পদ বৃদ্ধির একটি অপরিহার্য উপায় হিসেবে দেখার যৌক্তিকতা প্রতীয়মান হয়”। অর্থ্যাৎ শিক্ষা এখন আর অধিকার নয়, শিক্ষা হচ্ছে পন্য, সেটা নগত মূল্যে কিনে নিতে হবে। তাই শরিফ কমিশন বলছেঃ
 “... সস্তায় শিক্ষা লাভ করা যায় বলিয়া তাহাদের যে ভুল ধারনা রহিয়াছে, তাহা শীঘ্রই ত্যাগ করিতে হইবে। যেমন দাম তেমন জিনিস- এই অর্থনৈতিক সত্যকে অন্যান্য ব্যাপারে যেমন, শিক্ষার ব্যাপারেও তেমন এড়ানো দুষ্কর”।
কমিশন আরো বলছেঃ
“শিক্ষা সস্তায় পাওয়া সম্ভব নয়। বিশেষতঃ বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃষি এবং কারিগরি বিদ্যা ব্যয়বহুল”।
শিক্ষার ব্যয় সংকুলানে শরিফ কমিশনের সুপারিশ ছিলঃ

“...মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পর্কে আমরা সুপারিশ করছি যে, উক্ত ব্যয়ের শতকরা ৬০ ভাগ বেতন হইতে আদায় করা হউক এবং মাধ্যমিক স্কুলসমূহের পরিচালকগন ও সরকার প্রত্যেকে ২০ ভাগ করিয়া বহন করুন। ...এ ক্ষেত্রে পিতামাতাদের ত্যাগ স্বীকারের পরিমান অনেক বৃদ্ধি পাইবে। উচ্চতর শিক্ষার ক্ষেত্রেও আশা করা যায় যে আমাদের সুপারিশ অনুযায়ী ছাত্র বেতন বর্ধিত করা হইবে এবং জনসাধারনকেও সেই অনুপাতে ত্যাগ স্বীকার করিতে হইবে। ...... আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে জনসাধারন এইসব ত্যাগ স্বীকারে সম্মত হইবে। শিক্ষার দ্বারা শেষ পর্যন্ত তারাই উপকৃত হইবে”। যদিও শেষ পর্যন্ত জনগন এই ধরনের ত্যাগ স্বীকার অর্থাৎ ত্যাগ স্বীকারের নামে শোষন মেনে নিতে চায়নি। প্রবল ছাত্র বিক্ষোভের মুখে শরিফ কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন হয়নি।

১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা লাভের পর জনগন একটি শোষনহীন ও সমধিকার ভিত্তিক সমাজ চেয়েছিল। সেই সময়ে ১৯৭২ সালে গঠিত হয়েছিল ডঃ কুদরত-এ-খুদা কমিশন। স্বাধীনতার পরপর গঠিত হলেও সেই কমিশনের রিপোর্টেও জনআকাঙ্খার প্রতিফলন ঘটেনি।
সেখানেও শিক্ষাকে বানিজ্যিকী করনের প্রতি জোর দেয়া হয়েছিল। খুদা কমিশনের কিছু সুপারিশ সরাসরি শরিফ কমিশন থেকে নেওয়া হয়েছে। যেমন বলা হয়েছে “ শিল্পে মূলধন বিনিয়োগকে আমরা যে নজরে দেখি অনেকটা সেই নজরে শিক্ষাবাবদ অর্থ ব্যয়কে দেখার যৌক্তিকতা প্রতীয়মান হয়”। আরো বলা হয়েছে “... মাধ্যমিক ও কলেজ শিক্ষা সম্পর্কে আমরা সুপারিশ করি যে, এর ব্যয়ের শতকরা ৫০ ভাগ ছাত্র বেতন হতে আদায় করা হোক এবং অন্যান্য উৎস থেকে যা পাওয়া যাবে তা সহ সরকার বাকী ৫০ ভাগ বহন করুক। ...... বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে আশা করা যায় যে, ছাত্র বেতন বর্ধিত করা হবে। এবং জনসাধারকেও সে অনুপাতে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে”।
শরিফ কমিশন ও খুদা কমিশনের মধ্যে কোনো পার্থক্য আছে কি? আসলে উভয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষাকে বানিজ্যিকী করনের চেষ্টা চালানো হয়েছে। নারী শিক্ষা সম্পর্কেও খুদা কমিশন খুব নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে “অষ্টম শ্রেনীর লেখাপড়া শেষ করে আমাদের দেশের বহু মেয়ে পড়াশোনার সুযোগ পায় না। সুতরাং তাদের পাঠ্য বিষয়ে নিম্নলিখিত বিষয়সূচি থাকা একান্ত আবশ্যকঃ শিশুর যত্ন, রুগীর সেবা, স্বাস্থ্যবিধি, পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা, খাদ্যপুষ্টি, খাদ্য প্রস্তুত, খাদ্য সংরক্ষন, সূচীশিল্প ও পোষাক পরিচ্ছদ তৈরী, পুতুল ও খেলনা তৈরী, বাঁশ, বেত ও পাট প্রভৃতি কাজ, পাটি ও মাদুর বোনা, হাস-মুরগি ও গৃহপালিত পশুপালন ইত্যাদি”অর্থাৎ ধরেই নেওয়া হয়েছে যে নারীদের প্রকৃত শিক্ষার দরকার নেই। নারীরা কাজ করবে ঘরে তাই নারীদের শিক্ষার নামে দেওয়া হবে একঘেয়েমি দাসত্বের প্রশিক্ষন।

পরবর্তীতে শামসুল হক কমিশন, মিঞা কমিশন এবং জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ এ শিক্ষাকে বানিজ্যিকী করনের প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে। শামসুল হক কমিশন বলেছে “ দেশের বাস্তবতা এবং আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করতে হয়”
মিঞা কমিশন বলেছে “ বেসরকারী উদ্যোগে বিদ্যালয় স্থাপনকে উৎসাহিত করতে হবে...”।
জাতীয় শিক্ষানীতি কমিটি ২০০৯ এ বলা হয়েছে “
শিক্ষাখাতে বেসরকারী উদ্যোগ উৎসাহিত করা হবে। কলেজ ও উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ( অর্থাৎ তাদের পরিবারসমূহকে ) তাদের পড়াশোনার খরচ সংকুলানে নিজেদের দায়িত্ব ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি করতে হবে। যাদের প্রয়োজন তাদের সল্প সুদে ও সহজ শর্তে শিক্ষাঋনের ব্যবস্থা করার পদক্ষেপ নেয়া হবে”।
অর্থাৎ সব কথার এক কথা শিক্ষা সবার জন্য নয়। টাকা যার শিক্ষা তার, এই নীতিতে আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা চলে আসছে। তারই চরম ফলাফল দেখা যাচ্ছে বর্তমানের বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে। সেখানে ঝকঝকে চকচকে ক্যাম্পাসে শুধুই টাকার খেলা। রেস্টুরেন্টের খাদ্যের মূল্যতালিকার মত প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়ভিত্তিক মূল্য তালিকা আছে। পকেটের ওজন বুঝে বেছে নাও পছন্দের বিষয়। শুধু তাই নয় সাথে থাকছে ভর্তি হলে বিভিন্ন উপহার সামগ্রী। বিভিন্ন পন্যের বিজ্ঞাপনের মত সুশ্রী মডেলরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞাপন করে। আর দেশের যে গুটি কয়েক সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আছে সে গুলোকেও বেসরকারী খাতে নেওয়ার জন্য বিভিন্ন পায়তারা চলছে, সাথে রয়েছে বিদেশি প্রভুদের চাপ। তাই জনগনের শিক্ষার অধিকার আদায় করতে হলে জনগনকেই এর জন্য আন্দোলন করতে হবে।





৩টি মন্তব্য:

  1. uprukato beshoyti pare prashner udoy halo,bartaman shikka babasta munafa bettik na onnakisu?jiboner ekmatro lokka ki lakapara kare paisa kamanu na onnakichu.

    উত্তরমুছুন
  2. এখন পড়াশোনার মূল উদ্দেশ্য হয়ে গেছে টাকা কামানো। আর সেই পথটাও বেছে নিতে হয় টাকার মাধ্যমে। পুরো ব্যাপারটা হয়ে গেছে একটা পন্য। টাকা দিয়ে শিক্ষা কিনো তারপর সেই শিক্ষা অধিক দামে বিক্রি করো।ফলে শিক্ষা এখন সাধারন মানুষের কোনো কল্যানে আসে না। শিক্ষা হয়ে গেছে মুনাফা করার হাতিয়ার।

    উত্তরমুছুন
  3. aj thake 42 bachor agao shikkar ai abosta chilona,ki amon holo 42 bachorer moddoy shob change hay galo.puji patir ato uttan kibave holo bujina?

    উত্তরমুছুন