পোস্টকার্ড ব্লগের “ লোকায়ত কথোপকথন ” পাতাটি সবার জন্য উন্মুক্ত । লিখতে চাইলে আমাদের মেইল করে জানান । সাগ্রাহে আমরা আমান্ত্রন জানাবো। আমাদের মেইল ঠিকানা postcarduv@gmail.com। বাছাইকৃত লেখাটি পোস্ট কার্ড সংখ্যায় প্রকাশ করা হবে।

শুক্রবার, ৫ এপ্রিল, ২০১৩

আধুনিক সমাজের দাসব্যবস্থাঃ বুয়া ও গৃহকর্মী


“বুয়া শ্রেনী ও গৃহভৃত্য দের walk way তে হাটা নিষেধ”। এই লেখাটি ঢাকা শহরের একটি অভিজাত এলাকায় অবস্থিত একটি পার্কের বাইরে সাইন বোর্ডে লেখা আছে। এই পার্কটি হচ্ছে সেই অভিজাত এলাকার অধিবাসী দের বিকেলে বা সকালে হাটাহাটির জায়গা। আর বুয়া শ্রেনী ও গৃহভৃত্যরা হচ্ছে তাদের বাসায় যে সব গৃহ কর্মী কাজ করে সেসব ব্যক্তি। কি প্রচন্ড শ্রেনী বিদ্বেষ প্রকাশিত হয়েছে এই লেখাটির মধ্যে। বুয়াদের হাত ধরেই অভিজাতদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা এখানে খেলতে আসে, তারপরও বুয়ারা এখানে হাটতে পারবে না। এর পেছনে কি কোনো যুক্তি সঙ্গত কারন আছে? কারন আসলে একটাই সেটা হচ্ছে শ্রেনী বিভেদ। অভিজাত শ্রেনী বুয়া শ্রেনীদের তাদের সমঅধিকার ভুক্ত মানুষ মনে করে না। ক্ষেত্রবিশেষে ওদের মানুষই মনে করা হয় না। আমরা যতই একুশ শতকের অহংকার করিনা কেনো এখোনো এই সমাজ একটি শোষন মূলক সমাজই রয়ে গেছে। দাস প্রথা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে বলে মনে হলেও তা আসলে বিলুপ্ত হয়নি। শুধু তার আবরনটা বদলেছে। সেটা এখন আরো অনেক বেশি পরিশিলিত আর সুশীল রুপ ধারন করেছে। দাস প্রথার বিভিন্ন রুপের মধ্যে একটা হচ্ছে এই গৃহভৃত্য বা বাসার কাজের বুয়া।

আপাত দৃষ্টিতে মনে হতে পারে কাজের বুয়াদের দাস বলাটা বোধহয় একটু বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে। কারন ওরাতো আর কৃতদাসদের মত বিক্রী হয়ে যায় নি বা ওদের তো আর চাইলেও দাসদের মত বাজারে তুলে বিক্রী করা যাবে না। সেটা ঠিক এখন আর আগের মত রাস্তার মোড়ে দাড় করিয়ে মানুষ বিক্রি করার দিন নেই। কিন্তু তাই বলে ধনিক শ্রেনী কর্তৃক অসহায় শ্রেনীকে দাস বানানোর প্রথা বন্ধ নেই। এখন আরো সুন্দর ও নান্দনিক ভাবে এইসব কাজ করা হয়। এখন আর ওদের কৃতদাস বলা হয় না ,বলা হয় house servant বা গৃহকর্মী। নামের পরিবর্তন হলেও ওদের জীবনের সাথে কৃতদাসের জীবনের কোনো পার্থক্য নেই। গৃহকর্মীরা সূর্যোদয় থেকে শুরু করে রাতে ঘুমানোর আগ পর্যন্ত কাজ করতে বাধ্য হয়। সব মিলিয়ে কর্মঘন্টা হয় ১৬ থেকে ১৮ ঘন্টা, ক্ষেত্রবিশেষে যেটা ২০ ঘন্টা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তাদেরকে খেতে দেওয়া হয় ঘরের উচ্ছিষ্ট খাবার। তাদের জন্য নেই কোনো চিকিৎসা ব্যবস্থা, নেই কোনো বিনোদনের সুযোগ আর তার উপর আছে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। গৃহকর্মীদের উপর যে নির্মম নির্যাতন করা হয় তা মধ্যযুগের অত্যাচারকেও হার মানায়। অত্যাচারের নতুন নতুন পদ্ধতির মধ্যে আছে ইলেক্ট্রিক শক, চোখে মুখে মরিচ ঘষে দেওয়া, গরম খন্তির ছেকা, আঙ্গুলে সূচ ফুটিয়ে দেওয়া, ঘুমাতে না দেওয়া ইত্যাদি। আর আছে নির্যাতনের আদিম ও বহুল প্রচলিত এক পদ্ধতি যৌন নির্যাতন। নির্যাতন যে শুধু বাসার কর্তী করেন তাই না। বাসার ছোট থেকে বড় সব সদস্যের বিনোদনের বিষয় হচ্ছে গৃহকর্মীকে নির্যাতন।

এই ধরনের নির্যাতনের কথা আমরা তখনই জানতে পারি যখন কিছু নির্যাতন কারী পুলিশের হাতে গ্রেফতার হয়। কিন্তু সে হার খুব কম। গৃহকর্মীকে নির্যাতনের জন্য বছরে মাত্র দুই থেকে তিনজন গ্রেফতার হয়, অন্তত আমরা মিডিয়াতে তাই দেখি। কিন্তু তাদের কারও পরবর্তীতে শাস্তি হয়েছে এমন কোনো দৃষ্টান্ত দেখা যায় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এইসব মামলা নির্যাতিতের পরিবারের সাথে মিটিয়ে ফেলা হয়, বা সহজ ভাষায় নির্যাতিতরা মিটিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়।

কিন্তু একটা সমাজের এইধরনের নির্যাতন দিনের পর দিন চলতে পারে না। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এখনই দরকার। শ্রমদাসত্বমূলক এই প্রথা দূর করতে না পারলে শোষনহীন সুন্দর সমাজ কখোনোই গড়া সম্ভব হবে না। এই প্রথা দূর করার জন্য প্রথমেই যা করতে হবে তা হলো গৃহ শ্রমকে জাতীয় শ্রমনীতির আওতায় আনা। তবে শ্রমনীতির আওতায় আনা হলেও কিছু বিশেষ বিষয়ের প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। কারন সাধারন শ্রমিকদের থেকে গৃহশ্রমিকদের ব্যাপারটা একটু আলাদা। সাধারন শ্রমিকদের মত গৃহশ্রমিকদের কর্মক্ষেত্র আর বাসস্থান আলাদা নয়। গৃহশ্রমিকরা তাদের কর্মস্থল অর্থ্যাৎ মালিকের বাসস্থানেই থাকে ফলে তার সমগ্র জীবনের উপর মালিকের প্রভাব থাকে। সেজন্য গৃহশ্রমিকরা যাতে তাদের শ্রম সংক্রান্ত অধিকারের সাথে সাথে জীবনের অন্যান্য অধিকার গুলোও পেয়ে থাকে সে ব্যাপারে দৃষ্টি রাখতে হবে। গৃহ শ্রমিক আইনে যেসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে তা হলঃ

১। সাধারন শ্রমিক আইন অনুযায়ী প্রত্যেক গৃহশ্রমিকের কর্ম ঘন্টা হবে সর্বোচ্চ ৮ ঘন্টা। ৮ ঘন্টার অতিরিক্ত কাজ করালে ঘন্টা প্রতি দ্বিগুন হারে ওভার টাইম বেতন দিতে হবে। তবে কোনো অবস্থাতেই ওভারটাইম করার জন্য বাধ্য করা যাবে না।

২। গৃহশ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট বেতন কাঠামো ঘোষনা করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী বেতন দিতে হবে। এবং সেই বেতন নগদ অর্থমূল্যে পরিশোধ করতে হবে। কোনো অবস্থাতেই জামা কাপড়, জুতা ইত্যাদি দ্বারা বেতন পরিশোধ করা যাবে না।

৩। গৃহ শ্রমিক যেহেতু মালিকের গৃহেই অবস্থান করে তাই তার খাবার এর ব্যাবস্থা মালিকের খাবারের সাথেই করতে হবে তা না হলে তাকে পৃথকভাবে রান্নাবান্নার সুযোগ দিতে হবে।

৪। প্রত্যেক গৃহশ্রমিককে বিনোদনের পর্যাপ্ত সুযোগ দিতে হবে। সাথে সাথে ঘুমানোর পর্যাপ্ত সময় দিতে হবে।

৫। গৃহশ্রমিকদের সপ্তাহে নূন্যতম একদিন সাপ্তাহিক ছুটি দিতে হবে এবং এর জন্য কোনো প্রকার বেতন কাটা যাবে না।

৬। শ্রম আইন আনুযায়ী অন্যান্য ছুটি সমূহ গৃহশ্রমিকদের প্রদান করতে হবে। তবে ছুটির দিন যদি গৃহশ্রমিকরা মালিকের বিশেষ প্রয়োজনে কাজ করতে ইচ্ছুক থাকে তাহলে দ্বিগুন হারে ঘন্টা প্রতি পারিশ্রমিক প্রদান করতে হবে।

৭।গৃহশ্রমিকদের যেকোন ধরনের চিকিৎসা ব্যয় মালিককে বহন করতে হবে।

৮। দূর্ঘটনাজনিত কোনো প্রকার ক্ষয়ক্ষতির জন্য ( যেমন হাত থেকে পড়ে কাচের থালাবাসন ভেঙ্গে যাওয়া ) বেতন কাটা যাবে না।

৯। গৃহশ্রমিকদেরকে তাদের পরিবারের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ ও ফোনে কথা বলার সুযোগ দিতে হবে।

১০। গৃহশ্রমিকরা একমাসের নোটিশে কাজ ছেড়ে দিতে পারবে। কোনো অবস্থাতেই বাধ্যকরে কাজে বহাল রাখা যাবে না। সেই সাথে কাজ থেকে বাদ দিতে হলেও একমাস পূর্বে নোটিশ দিতে হবে।

১১। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার হচ্ছে কোনো অবস্থাতে এবং কোনো অজুহাতেই গৃহকর্মীদের শারীরিক এবং মানসিক ভাবে নির্যাতন করা যাবে না। এইধরনের যেকোন প্রকার নির্যাতন ফৌজদারী অপরাধ বলে গন্য হবে। এক্ষেত্রে গৃহকর্মীদেরকে রাষ্ট্র কর্তৃক আইনি সহায়তা দিতে হবে। নির্যাতনের শিকার গৃহকর্মীরা যাতে সহজে অভিযোগ জানাতে পারে তারজন্য একটি হট লাইনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সাথে সাথে প্রত্যেক গৃহকর্মীকে পরিচয় পত্র প্রদান করতে হবে যাতে বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্র কর্তৃক তাদের খোজখবর রাখা যায়।

পরিশেষে এটাই বলতে চাই গৃহকর্মীরা আমাদের সমাজেরই মানুষ। এবং আমাদের সমাজের জন্য তারা খুবই গুরুত্বপূর্ন। গৃহকর্মীদের ছাড়া আজকের কর্পোরেট শ্রেনীর মানুষরা আসহায়। তাই আমাদের জাতীয় আয়ে পরোক্ষভাবে হলেও তাদের বিশাল অবদান আছে। সমাজের এইসব শ্রমজীবি মানুষকে নির্যাতন ও নিপীড়ন করে, তাদের অধিকার বঞ্চিত রেখে আমরা শুধু একটি অমানবিক ও নিষ্ঠুর সমাজই তৈরী করতে পারবো। তাই সুন্দর সমাজ গড়তে দেশের সব সচেতন মানুষকেই এই ধরনের শোষনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।



২টি মন্তব্য:

  1. Amar Paribare ai beshoy nea pratidin jogra hoy amar sate .keno Ekta kajer luk tik kare dena.sai jonno amake onek kotai sunte hoy.Amra je ekta chrenni chetona dharon kare seta kinto parebare bujte chaina.keno ekjon manushke basai reke kajer luk hesaba treat karbo.

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. লড়াইটা যদিও ঘর থেকে শুরু করতে হবে তদুপরি মূল সমস্যাটা দূর করতে হলে সমাজে একটা সামগ্রিক পরিবর্তন করতে হবে। মানুষ মানুষের বাসায় দাস হয়ে থাকুক এইটা আমরা চাই না। কিন্তু যতদিন না সমাজ সেই আবস্থা পৌছাচ্ছে ততদিন অন্তত এই মানুষগুলো যাতে মানুষ হিসেবে মূল্য পায়, তার শ্রমের উপযুক্ত মূল্য পায় সেটা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব।

      মুছুন