সাম্প্রতিক ঈদের আগে আমাদের দেশে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় ছিল সানি লিওন। সানি লিওন হচ্ছে কানাডার সাবেক পর্ণো চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী বছর খানেক আগেই যার বলিউডে অভিষেক
হয়েছে। তবে আমাদের আলোচিত সানি লিওন কিন্তু ব্যক্তি সানি লিওন নয়। ঈদের আগে বাংলাদেশে
তার নামে একটি পোষাক এসেছিল ভারত থেকে, যা পুরো বাঙ্গালী মধ্যবিত্ত সমাজের ভিতকে একটা জোড়েসোরে ঝাকুনি দিয়েছে।
কি ছিল সেই পোষাকে যাতে তা নিয়ে পুরো দেশে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। ঝড় উঠলো সোস্যাল মিডিয়াতে। এমন কি এই পোষাক নিয়ে অনেক ধরনের মজার মজার কৌতুকও চালু হয়েছে। যেমন দোকানদার তার বন্ধুকে বলছে জানিস আজ একজন সানি লিওনের ড্রেস কিনতে এসেছিল, আমি তাকে একটা খালি প্যাকেট ধরিয়ে দিয়েছি, হা হা হা।
না এই পোষাক নিয়ে সোস্যাল মিডিয়াতে যে ধরনের হাসি তামাশা বা কৌতুক হয়েছে বাস্তবে
পোষাকটি অতোটা অশ্লীল ছিল না। সমস্যাটি পোষাকের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ বা দাম নিয়ে নয়। সমস্যা
হচ্ছে পোষাকটি এমন এক সেলিব্রেটির যার পেশাকে আমরা আমাদের ভদ্র সমাজে স্বীকৃতি না দিলেও
আমাদের সমাজ তাকে টিকিয়ে রেখেছে যুগের পর যুগ ধরে।
সানি লিওন পর্ণোগ্রাফীর অভিনেত্রী বা সোজা বাংলায় সে দেহজীবি। তবে এই দেহজীবি
আর সংসদ ভবনের সামনে সস্তা প্রসাধনী মেখে খদ্দেরের অপেক্ষায় দাড়িয়ে থাকা দেহজীবি এক
জিনিস নয়। এ খোদ কানাডা থেকে আমদানি করা আধুনিক এক ব্রান্ডেড পণ্য যার শিল্পকর্ম দেখতে
সহজ সরল ভেতো বাঙ্গালীরাও হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
আর তাই বাংলাদেশে যখন সানি লিওনের প্রথম বলিউড ফিল্ম জিসম-টু পাইরেটেড হয়ে
চলে আসে তখন সেটা নিয়ে সমালোচনার বদলে চলতে থাকে হট কেক বা গরম পিঠের মত কাড়াকাড়ি।
অনুসন্ধিৎসু বাঙ্গালীর মন তখন জানতে চায় সানি লিওনের ন্দি সিনেমায় অভিনয় করা কি পিএইচডি
করার পর এইচএসসি পরীক্ষা দেওয়া না এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার সমতুল্য।
তাহলে প্রশ্ন দাড়াচ্ছে সানি লিওনের নামের পোষাক নিয়ে বাঙ্গালীর মনে এত আতঙ্ক
কেনো। আসলে সে অতঙ্কের মূল কারন হচ্ছে আমাদের পুরোনো জং ধরা পুরুষতান্ত্রিক ভোগবাদী
মন। যতক্ষন সানি লিওন আমাদের মনোরঞ্জন করছে বা ম্যাড়মেড়ে জীবনে একটু ঝাকি দিচ্ছে ততক্ষন
সব ঠিক আছে। আমাদের ভোগবাদী মন আতঙ্কগ্রস্থ হয় তখনই যখন সানি লিওন আমাদের ভোগের চৌহদ্দি
পেরিয়ে ব্যক্তি জীবনে ঢুকে পড়ে।
আমাদের স্ত্রী বা বোনকে সানি লিওনের পোষাকে (তার দৈর্ঘ্য যতই হোক নামতো সানি
লিওন) কল্পনা করে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক মনে আতঙ্কের শীতল স্রোত বয়ে যায়। আমাদের মনে
পড়ে যায় সানি লিওনকে ঘিরে পুরুষদের অবদমিত ভোগবাদী চিন্তাগুলো, যা হয়তো অন্য কেউ আমার
বোন বা মেয়েকে নিয়ে ভাবতে পারে। তাই আমাদের ভীতু মন তখন সানি লিওনের ফ্যান্টাসিকে ভুলে
তাকে উচ্ছেদ করতে প্রতিবাদ মুখর হয়ে উঠে। আমরা একবারও ভেবে দেখি না এভাবে সানি লিওনকে
তাড়ানো গেলেও তার ভূত কিন্তু ঠিকই রয়ে যাবে আমাদের ঘাড়ে চেপে।
তাহলে আমাদের কি করা উচিত। ভিনদেশ থেকে এভাবে সানি লিওন, ক্যাটরিনা, কারিনা
নামক বিভিন্ন উচ্চ শ্রেনীর দেহজীবিদের নামে আমাদের দেশে বিভিন্ন পোষাক আমদানি হবে,
তা নিয়ে সারাদেশে কাড়াকাড়ি শুরু হয়ে যাবে, আর আমরা শুধু বসে বসে দেখবো। না এটাও কোনো
সমাধান নয়। এর প্রতিবাদ অবশ্যই করতে হবে। তবে প্রতিবাদের আগে প্রতিবাদের উদ্দেশ্যটা
আগে ভালোভাবে বুঝতে হবে। আমাদের প্রতিবাদের উদ্দেশ্য কি শুধুই সানি লিওন নামক ব্যক্তি
বিশেষের বা তা বিশেষ পোষাকের বিরুদ্ধে। নাকি এই ধরনের সানি লিওন, ক্যাটরিনা, কারিনা
ও দিপীকাদের নিয়ে গড়ে উঠা একধরনের ভোগবাদী সংস্কৃতির বিরুদ্ধে, যা নারীকে মানুষের পর্যায়ে
না রেখে নামিয়ে আনে দোকানের দামী পন্যের তালিকায়।
যদি এই ভোগবাদী সংস্কৃতির বিপক্ষেই আমাদের প্রতিবাদ হয় তাহলে আমাদের বলতে হবে
আমরা এই পুরো সংস্কৃতিরই অবসান চাই যা আমাদের মা, বোন, কন্যাদের ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে
ব্যবহার করে। এই সংস্কৃতিটি এতোই ভয়াবহ যে তা আমাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয় আধুনিক মেয়ে
মানেই দৈহিকভাবে আকর্ষনীয় হতে হবে। অর্থ্যাৎ তাকে শুধু সুন্দর হলেই হবে না তাকে আবেদনময়ী
হতে হবে। আর যার প্রশিক্ষনের জন্য দেশব্যাপী তথা পুরো বিশ্বব্যাপী চলছে সৌন্দর্য প্রতিযোগীতার
নামে রমরমা স্বীকৃত যৌন ব্যবসা। যেখানে প্রধান পন্য হচ্ছে নারী। সেখানে বিচার হয় কে
নিজেকে কতটা আকর্ষনীয় ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে অর্থ্যাৎ নিজেকে কে সুন্দর পন্য হিসেবে
জাহির করতে পারে। আর যারা নিজেকে সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারে তাদের জন্য আছে বিচারকের
বিভিন্ন যৌন সুরসুরি যু্ক্ত প্রশংসামূলক বাক্য।
এই সংস্কৃতির প্রভাব যে শুধু অভিনয় বা বিজ্ঞাপন জগতে আছে তা কিন্তু নয়। এই
ভোগের ডামাডোলে পড়ে এখন গানও শোনার বস্তু থেকে দেখার বস্তু হয়ে গেছে। তাই স্যাটেলাইটের
বদৌলতে এখন বাঙ্গালী গানের মাধ্যমে জানতে পারে ‘চামেলী কত চিকনি’ বা ‘শিলার যৌবন’ কতটা
উদ্দীপক। ‘মুন্নীর কেনো বদনাম’ হলো তা নিয়েও আমাদের মাথা ব্যাথা কম নয়। তো এভাবে একদিকে
‘উ লা লা উ লা লা’ সংস্কৃতি চালু করে রেখে অপরদিকে কোনো ভাবেই সানি লিওনদের আগমনকে
ঠেকানো যাবে না। কোনো না কোনো রুপে তা আমাদের সমাজে প্রবেশ করবেই। আর তার আঘাত বিষাক্ত
সাপের ছোবলের চেয়ে কোনো অংশে কম হবে না। সে লক্ষন পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে যেখান থেকে
এইসব অপসংস্কৃতি আমাদের দেশে প্রবেশ করেছে সেখানে খুব ভয়াবহ ভাবে দেখা দিয়েছে। বাসে
মেডিকেল ছাত্রীকে ধর্ষণ করে হত্যা করা কি শুধুই কিছু ব্যক্তিবিশেষের দ্বারা সংঘটিত
বিছিন্ন ঘটনা নাকি তার পেছনে পুরো ভারত জুড়ে চলা নারীকেন্দ্রিক অশ্লীল বিনোদনের প্রত্যক্ষ
ও পরোক্ষ প্রভাব আছে তা নিয়ে এখন ভারতের সমাজ বিজ্ঞানীরা নতুন করে ভাবছে।
আমাদেরও নতুন করে ভাবতে হবে। ভাবতে হবে আমরা আমাদের দেশের নারীদের কিরুপে দেখতে চাই। আমাদের কন্যাদের কি আমরা আবেদনময়ী, নির্বোধ ও পুরুষের ভোগের বস্তু হিসেবে দেখতে চাই নাকি তাদের মননশীল, সৃজনশীল ও মানবিক বোধ সম্পন্ন মানুষ হিসেবে দেখতে চাই। আমাদের মেয়েদের আদর্শ কে হবে, প্রীতি লতা ও বেগম রোকেয়া নাকি ‘চিকনি চামেলী’ ও ‘শিলা কি জাওয়ানী’ খ্যাত ক্যাটরিনা তা আমাদেরই ভাবতে হবে। আর এই ভাবনাটা যত দ্রুত করা যায় ততই ভালো, তা না হলে অদূর ভবিষ্যতে আর সানি লিওনদের আমদানি করতে হবে না। আমাদের কর্পোরেট বিনোদন জগত তখন দেশেই সানি লিওন তৈরী করে বিদেশে রপ্তানী করবে।